‘পরিবার নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’টি প্রায় নিঃশেষ!
ডা. জাকির হোসেন
এবার মেয়েপক্ষের কৃতকর্মের বিশ্লেষণে আসি। বনানীর ওই চার তারকা হোটেলে রাত দুটোর পার্টিতে নিজের পরিবারের লোকজন ছাড়া বন্ধুর সঙ্গে উপস্থিত হওয়া আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল? তাদেরও পিতা-মাতা ছিল। তারাও অন্য দশজন সন্তানের মতো নিজের পরিবার থেকে একটা পারিবারিক শিক্ষা নিয়েই বড় হয়েছেন। আমাদের সমাজে আজকে যারা প্রতিষ্ঠিত তাদের প্রত্যেকের জীবনী নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পরিবারের একটা বিশাল ভূমিকা ছিল তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের পেছনে। ঘটনার পর অনেক পত্রিকায় লেখা-লিখি হচ্ছে। ফেসবুকে নিউজগুলো ভাইরাল হচ্ছে। সচেতন মহল একেকজন একেকভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন। পুলিশ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেছেন। হয়তো দেশের প্রচলিত আইন অনুয়ায়ী একদিন অপরাধীদের বিচারও হবে। কিন্তু সবকিছু কী আইন সমাধান করে দিতে পারে? আইন কী ফিরিয়ে দিতে পারবে সম্ভ্রম হারানো নারীর আজীবনের লালিত সম্ভ্রম? আইন কী চিকিৎসা করতে পারবে তাদের মানসিক যন্ত্রণার? আইন কী তাদের ফিরিয়ে দিতে পারবে তাদের হারিয়ে যাওয়া সামাজিক মান-মর্যাদার। আমার মতে, পারবে না।
একটা কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি কিন্তু অনেক কিছুর সমাধান করে দিতে পারে। ধরুন, একটি রাস্তার পাশে একটি স্কুল আছে। প্রতিদিন ছুটির পর রাস্তা পার হতে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের দুর্ঘটনায় পতিত হতে হয়। এক বিজ্ঞ আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করলেন। মহামান্য হাইকোর্ট রায় দিলেন, ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় নামতে পারবে না। দেখা গেল, এতে করে দুর্ঘটনা রোধ হলো না। একদিন একজন ইঞ্জিনিয়ার এ ধরনের দুর্ঘটনার নিউজ পত্রিকায় পড়ে স্কুলের পাশের রাস্তাটি পরির্দশন করলেন। তিনি সরকারের কাছে প্রস্তাব দিলেন, অল্পকিছু টাকার খরচ করলেই এই দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। সরকার তার কথামতো বাজেট বরাদ্দ দিল। তিনি রাস্তাটিকে লোহার বেড়ায় আবদ্ধ করে দিয়ে একটি বিকল্প রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা করে দিলেন। দেখা গেল আইন যা পারল না সেটা একজন ইঞ্জিনিয়ারের কাটামোগত জ্ঞান দ্বারা সম্ভব হলো। তদ্রুপ ঘটনাটি আমি একটু নৈতিক ও পারিবারিক শিক্ষার দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম। আমরা সবাই পরিবার নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম শিক্ষা লাভ করি। প্রতিটি সমাজেই পরিবার হলো আমাদের সন্তানদের সামাজিকভাবে গড়ে ওঠার একটি প্রাথমিক ও প্রধান শিক্ষালয়। পরিবার যেমন পরিবারের সবার সঙ্গে আত্মার বন্ধন তৈরি করতে শেখায়, তেমনিভাবে পরিবারের বাইরের আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও পরিবার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি সমাজেরই একটি নীতিবোধ থাকে, একটি মূল্যবোধ থাকে। পরিবারের অভিভাবকগণ সেই মূল্যবোধ কোমলমতি সন্তানদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত করে দেন।
সন্তান যখন পরিবারিক শিক্ষার গ-ির বাইরে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত শুরু করে তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পিতৃতুল্য শিক্ষকগণ সে দায়িত্ব পালন করেন। তবে কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই পারিবারিক শিক্ষা এবং আমাদের সেই পরিবার? তবে কী বেগ কিংবা ব্যস্ততার এই জীবন আমাদের সন্তানদের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী? আমরা অভিভাবকরা কী সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের আশায় বিত্ত-বৈভবের পেছনে ছুটে চলে সন্তানদের বিপথগামী করে তুলছি? শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে হবে না, প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে জাতীয় পর্যায় থেকে। জাতীয় পর্যায়ে সকলে বসে শুধু আইনি কাঠামোর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা ভাবলে জাতি হিসেবে আমরা আরও পিছিয়ে যাব। সময় এখন শিক্ষার মৌলিক উপাদান এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে যতন করা এবং নিজেদের হৃদয়ে লালন করা। (শেষ)
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান