নারীর প্রতি এমন নিষ্ঠুর নারকীয়তা কেন?
অরুণ কুমার বিশ্বাস
প্রসঙ্গে যাবার আগে একটি ঘরোয়া চিত্র এঁকে নিই, তাতে গুরুগম্ভীর আলোচনা করতে সুবিধা হয়। ফায়েজ মতিন আদতে অশিক্ষিত নন, তবে তিনি নিত্য স্ত্রীকে বকাঝকা, যা নয় তাই বলে গালমন্দ করেন। ফায়েজের ছেলেমেয়েরা তা দেখে, কখনো মায়ের কষ্টে মন খারাপ করে। আবার কখনো চেঁচিয়ে কাঁদে বাপ যখন ওদের মাকে মশামারা ইলেকক্ট্রিক ব্যাট দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটায়। মারধোরের কারণ খুব স্পষ্টÑ ফায়েজকে তার স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে চাহিদামতো টাকাকড়ি বা যৌতুক এনে দেয়নি।
এমন নয় যে ফায়েজ মতিন নেহাতই ছাপোষা মানুষ। তার চাকরি আছে, মাসান্তে ভাল বেতন পান। নানাসূত্রে উপরি কামাইও মন্দ নয়। সবচেয়ে বড় কথা মনসুখের জন্য তার বান্ধবীও জুটেছে ইদানীং। এই নিয়ে স্ত্রী কিছু বললেই বাবুর মুখভার। তখন তিনি ছেলেমেয়ের সামনেই অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তি করেন, সাথে মশামারা ব্যাটের সদ্ব্যবহার তো আছেই। এর নাম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। স্বামী অন্য মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করলেও কিছু বলার নেই, কিন্তু স্ত্রী ফেসবুকে ঢুকলেই তার চরিত্রের চৌকিদারি শুরু করেন এই ফায়েজ মতিনের মতো পুরুষেরা।
ফলে কী হলো, ফায়েজের ছেলে বাপের থেকে এই শিখলো যে, মেয়েরা মানুষ হিসেবে নিকৃষ্টতর, তাদের সাথে যা খুশি তাই করা যায়। এমনকি গায়ে হাত তোলাও অসংগত কিছু নয়। ছেলেটা তার বুকের গভীরে বাপের মতোন একজন নিষ্ঠুর দুশ্চরিত্র পুরুষকে লালন করে, যে কিনা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে নারী নির্যাতনকারী বা ধর্ষক। অন্যদিকে মেয়েটি কী শিখলোÑ শিখলো যে তার মা এভাবে নির্যাতিত হয়েও মুখ বুজে আছে। মেয়ে মানেই অবোলা, তার প্রতি যতই অনাচার অবিচার হোক, তাকে কিছু বলতে নেই। সে মেয়ে, তাই চুপচাপ সয়ে যেতে হয়, নইলে সমাজ তাকে দজ্জাল মেয়েমানুষ বলবে। তার খুব নিন্দেমন্দ হবে। ফায়েজের মেয়ে মায়ের কষ্টে মুখ লুকিয়ে কাঁদে, কিন্তু বাপের সামনে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সে সাহস করে না। বাপ যদি তাকে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দেয় এই ভয়ে।
এই চিত্রটি কিন্তু বিরলপ্রজ কিছু নয়। দশটি ঘরের খবর নিলে এমন দু-একজন ধর্ষকামী পুুরুষ আপনি পাবেন। ইদানীং নারীর প্রতি যে নিষ্ঠুর পাশবিক নির্যাতন চলছে, তার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণ কিন্তু বেশ গভীরে প্রোথিত। পরিবার থেকেই পুরুষ মূলত নারীকে অবহেলা করার শিক্ষা পায়। আমরা মুখে যতই বলি মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, আদতে তার কতটুকু পালন করি! প্রতিটি ধর্মে নারীকে যথোচিত মর্যাদা দেবার কথা বলা আছে। নারী মায়ের জাত, জগত-সংসারে তাবৎ সৃষ্টির পেছনে নারীই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মা নেই সঙ্গে যার, সংসার অরণ্য তার! এমন অনেক কথা বইয়ে পড়ি, কিন্তু আমরা আদতে তা লালন করি না।
একটি ছেলে বড় হয়ে ধর্ষক হবে, যদি সে পরিবারে মেয়েদের সম্মান পেতে না দেখে। ফায়েজের মতো গোঁয়ার পুরুষেরা মনে করে, নারীকে অসম্মান করলেই পৌরুষত্ব প্রমাণ হয়, কিন্তু মনুষ্যত্বের বিচারে সে তো মানুষ নয়। এখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। নারী-পুরুষ ভেদের এখানে কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিককালে ধর্ষণের ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাবার পেছনে অন্যতম কারণ এই কুকাজটি করেও ওরা দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আইনের সঠিক প্রয়োগ এখানে হয় না।
পাঠ্যবইয়ে নৈতিকতার পাঠ নেই বললেই চলে। কার্যত একটি ছেলে বা মেয়ের নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি হয় পরিবারের গুরুজন ও শিক্ষকদের মাধ্যমে। গোড়াতেই যদি বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা ছেঁটে দেওয়া যেত, বা ওই বৃক্ষটি উপ্তই না হতো তাহলে আমাদের আজকের এই বিভীষিকাময় ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করতে হতো না।
আমরা চাই ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হোক। বিচারে এদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হোক। এদের বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরে সবাইকে জ্ঞাত করতে হবে যে এরা সমাজের শত্রু। এদের থেকে সবাই সতর্ক থাকুন। ভিকটিম নয়, আমরা ধর্ষকের মসিলিপ্ত চেহারা দেখতে চাই। নইলে এমন দিন আসবে যখন নারীরা আর কোনো অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত পুরুষকে আস্থায় নিতে পারবে না। পুরুষের থেকে নারীরা ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হবে। কেবলই মনে হবে ওই পুরুষের মধ্যে হয়তো কোনো ঘৃণ্য নারী নির্যাতনকারী লুকিয়ে আছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান