নিজের হাত সেলাই করা শিল্পী!
মাহফুজ জুয়েল
একটা প্রবাদ আছে, যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। মানে হচ্ছে, যাকে পছন্দ করি না তার সবকিছুই খারাপ। এখানে ‘দেখতে নারি’ মানে হচ্ছে, যাকে ‘দেখতে পারি না’। ন-এ আকার র-এ হ্রস্ব-ইকার দিয়ে যে নারী, তার মানে হচ্ছে, পারি না। কিন্তু নারীর এই বানানটা দীর্ঘ-ইকার দিয়ে লিখে যদি ‘নারী’ লেখা হয়, তাতেও মনে হয় খুব একটা অর্থহানি ঘটে না!
পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ায় ‘নারী’ মানেও এক ধরনের ‘নারি’; যে পারে না। যে অক্ষম, দুর্বল, লুতুপুতু পুতুল। যার কোনোকিছুই ভালো নয়, কঠিন নয়, কষ্টের নয়। যার কোনো সৃষ্টিই শিল্প নয়, আবিষ্কার নয়, কাজ নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই নারীর কঠিনতম কাজটিও পুরুষের চোখে সহজতম কাজ বা কোনো কাজই নয়।
ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিকভাবে পুরুষ ‘নারীর কাজ’ বলতে ঘর-গেরস্থালির কাজÑ রান্না-বান্না, সেলাই এবং শিশু লালন-পালনের কাজকে বোঝে। এসব কাজ নারীর জন্য যত কঠিন ও দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন, পুরুষের কাছে এসব কাজ কোনো কাজই নয়। গতকালও ছিল না। আজও নয়। নারীর কাজের প্রতি পুরুষের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘চোখে সুঁই’ দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন লন্ডনভিত্তিক শিল্পী এলিজা বেনেত। তিনি সুঁই-সুতা দিয়ে নিজের হাতের তালুতে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পকর্ম। ‘নারীর কাজ কখনো শেষ হয় না’ (অ্যা উইম্যান’স ওয়ার্ক ইজ নেভার ডান) শিরোনামে তিনি এই শিল্পকর্মের আলোকচিত্র ও ভিডিও প্রদর্শন করেন।
এলিজার এই শিল্পকর্ম ‘নারীর কাজ’-এর প্রতি সমাজের নেতিবাচক ধারণাকে থতমত খাইয়ে দেয়। তার এই দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক শিল্পকর্ম ও কৌশল আমাদের দৃষ্টিকে আহত করে এবং একটু অন্যভাবে ভাবতে শেখায়।
এই অভিনব শিল্পকর্মের পদ্ধতি বিষয়ে এলিজা বেনেত প্রচারমাধ্যমকে বলেছেন, এই পদ্ধতিটি, (সুঁই-সুতায় হাত সেলাই) আমি প্রথম ব্যবহার করেছিলাম স্কুলে পড়া অবস্থায়, টেবিলের নিচে, হোম ইকোনোমিকস ক্লাসে। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। যখন দেখলাম আমি আমার হাতের তালুর ঠিক উপরের স্তরে সুঁই ঢুকাতে পারি! অথচ কোনোরকম যন্ত্রণা হয় না! সামান্য একটু অস্বস্তি হওয়া ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই! কিন্তু ছোটবেলার এ রকম আরও অনেক দুষ্টুমির মতো আমি বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলাম এবং বিষয়টি নিয়ে পরেও তেমন কিছু কখনো ভাবিনি। সম্প্রতি যখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, কায়িক শ্রমের শ্রমিকদের হাত যে রকম, তাদের হাতে যে রকম কড়া পড়ে, আমি সে রকম কড়া আঁকতে চাই, আমার হাতে, তাও আবার সুঁই-সুতায় সেলাই করে, তখন হুট করেই বিষয়টি মনে পড়ল।
এলিজা বেনেতের এই শিল্পকর্মকে কোনো কোনো দর্শক-বোদ্ধা ‘নারীবাদী প্রতিবাদ’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। যদিও শিল্পী নিজে ‘মানবিক মূল্যবোধ’ হিসেবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তার ভাবনায়, অনেক পুরুষও সেবা, পরিচারক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এসব কাজ ঐতিহ্যগতভাবে নারীদের কাজ হিসেবে বিবেচিত এবং সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে তা অদৃশ্য থাকে। মেয়েদের কাজ বা ‘নারীদের কাজ মানেই সহজ কাজ’Ñ মানুষ যাতে এই ভুল বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, আমি সেজন্যই কাজ করছি। আমি সেসব কাজকেই সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমি চাই ‘মেয়েদের কাজ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া, অবজ্ঞা-অবমান করা, সস্তা ও শারীরিক শ্রমের এসব কাজ সম্পর্কে সবাই সচেতন হোক।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান