যে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিলেন তিনি সেদিন
বাহালুল মজনুন চুন্নু
দিনটি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে যে নিদারুণ কষ্টের দিন কাটাচ্ছিলাম, তার অবসান হওয়ার স্বপ্ন উঁকি দিয়ে গেল মনে। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর পর ওইদিন বুঝেছিলাম, সময় আসছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে যারা ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করছিল, দেশকে যারা পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল কূটকৌশলের মাধ্যমে, সেই সব পরাজিত শক্তিকে এই বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ করার। যার হাত ধরে একটি জাতির জন্ম, তারই উত্তরসূরি যে জাতির ক্রান্তিলগ্নে জীবনবাজি রেখে এগিয়ে যাবেন সম্মুখপানে, জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হবেন, তা সেদিনই বুুঝেছিলাম। লক্ষ কোটি জনতা সেদিন তা বুঝেছিল, উপলব্ধি করেছিল হৃদয় দিয়ে। সেই দিনটি ছিল ১৭ মে, ১৯৮১। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে এলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে। এদেশের ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের কালো মেঘের ঘনঘটা, ক্যু-হত্যা যখন নিত্য নৈমত্তিক, জাতি যখন নেতৃত্বশূন্য ও লক্ষ্যভ্রষ্ট; তখনই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। নেতা আসবেন, তাই তাকে স্বাগত জানানোর জন্য একমাস আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। আমরা সংগঠিত করেছিলাম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। আমরা সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছিলাম। ছাত্রলীগের সকল নেতাকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জড়ো হয়েছিল সেদিন। তারপর সেখান থেকে আমরা গিয়েছিলাম বিমানবন্দরে, নেতাকে স্বাগত জানাতে। পুরো বিমানবন্দর এলাকা লোকে লোকারণ্য, যেন জনসমুদ্র। গণতন্ত্রের মুখোশধারী স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু আর অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে সেদিন জনসমুদ্র ছুটে এসেছিল প্রাণের নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে। সবার মুখে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান। হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি, রঙ্গিন পোস্টার, ব্যানার, নৌকার প্রতিকৃতি। সেই জনসমুদ্র দেখে আবেগে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। পিতা এবং তার কন্যার প্রতি মানুষের এত গভীর ভালোবাসা দেখে আবেগের অশ্রুকে রুদ্ধ করতে পারিনি সেদিন।
এর কিছুক্ষণ পর বিমানের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পুষ্পার্ঘ্যে শোভিত বঙ্গবন্ধুকন্যা জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিবাদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দ-বেদনায় কান্নার রোল ওঠে সমগ্র বিমানবন্দর এলাকা জুড়ে। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, সেøাগানের মাধ্যমে নেত্রীকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হচ্ছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম-পিতৃ হত্যার বদলা নেবো’ সেøাগানটি। এই সেøাগানটির মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি, শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা। মানুষের সেই তীব্র ভালোবাসা দেখে শেখ হাসিনা নিজেও কান্না ধরে রাখতে পারেননি। এতদিন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ জমাট বেঁধে ছিল বুকের ভেতরে, তা অশ্রুবিন্দু হয়ে দুচোখ বেয়ে নেমেছিল তার। সেদিন তিনি পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে শেরে বাংলা নগরের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘বাংলার জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি এসেছি, মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমি এসেছিÑ আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতি হতে দূরে থেকে আমি ঘরসংসার করছিলাম। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ছোট ভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ সেদিন তার সেই বক্তৃতা দিশেহারা আমাদের দিয়েছিল নতুন আলোর দিশা, নতুন জীবনের দিশা।
১৫ আগস্টের মাত্র কয়েনদিন আগেই তিনি স্বামীর সঙ্গে তার কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে গিয়েছিলেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে হত্যা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সব ধরনের চেষ্টা করেছিল। জার্মানি দূতাবাস তাকে আশ্রয় দিতে পারেনি বিভিন্ন চাপের মুখে। ওরাই লন্ডনে যোগাযোগ করে শেখ হাসিনা ও রেহানাকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু লন্ডনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন দুবোন। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পরম মমতায় তাদেরকে নিজ দেশে আশ্রয় দেন। দীর্ঘ ছয় বছর তিনি দিল্লিতে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। দিল্লি হতে ঢাকা আকাশপথে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তিনি দেশে আসতে পারছিলেন না। কারণ সামরিক সরকার তাকে দেশে আসার অনুমতি দিচ্ছিল না। সেই সময়টায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণ করা দূরে থাক, শেখ মুজিবের নাম নেওয়াটাই ছিল এক বিরাট অপরাধ। এমন পরিস্থিতিতে তার কন্যা দেশে ফিরবেন তা এককথায় অসম্ভবই ছিল।
ওই সময়টা ছিল উত্তাল এক সময়। দেশব্যাপী ছিল এক অস্থির ও অরাজক পরিস্থিতি। যেন আগ্নেয়গিরির ওপর বসেছিল দেশ। আওয়ামী লীগ ছিল কোণঠাসা, ছত্রভঙ্গ, বহুধা বিভক্ত। এমন পরিস্থিতির মাঝেই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আব্দুল মান্নান, বেগম সাজেদা চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ডা. এস.এ. মালেকসহ ডাকসাইটে নেতারা এবং অগণিত কর্মী সমর্থকরা শেখ হাসিনাকে সভাপতি করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ‘জাতির পিতার রক্ত বইছে যার দেহে, তিনিই পারবেন আওয়ামী লীগকে তার ক্রান্তিদশা থেকে উঠিয়ে অতীত ঐতিহ্যর মতো সমুজ্জ্বল করে তুলে ধরতে’, এমন বিশ্বাস থেকেই নেতাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। কিন্তু ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিভীষিকাময় বৈরী পরিবেশে স্বদেশের মাটিতে এসে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ছিল অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু শেখ হাসিনার শরীরে প্রবাহিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি অকুতোভয় দেশপ্রেমিক শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনার এই পদ গ্রহণে সম্মতি প্রদান করা ছিল এক বিরল সাহসী পদক্ষেপ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি তার চেয়েও বেশি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।
১৯৮১ সালের ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে শেখ হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেই তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন। সেই সময় থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে ফেরার পরদিন থেকেই শেখ হাসিনা একদিকে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও ভাবাদর্শগতভাবে সুসংবদ্ধ করে তোলার লক্ষ্যে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন। বহুধাবিভক্ত ব্র্যাকেটবন্দি আওয়ামী লীগকে জাতীয় মূলধারার প্রধান দল হিসেবে গুছিয়ে তোলা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটিকে যুগোপযোগী করে তুলেছেন। তারই হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর মধ্যদিয়ে দেশ দায়মুক্ত, কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে। তারই বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছার। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্র্বত্রই আজ উন্নয়নের জোয়ার। ধৈর্য ও সাহসের প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনা বহুমাত্রিক এক জ্যোতিষ্ক। তাকে কেন্দ্র করে, তার নেতৃত্বেই আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। সেজন্যই প্রয়াত কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই বলতে হয়, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’।
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান