বনানীর রেইনট্রি, সমাজের বিষবৃক্ষের প্রতিচ্ছবি
মঞ্জুরুল আলম পান্না
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনায় বেশ তোলপাড় বাংলাদেশ। গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো বটেই, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে গণমাধ্যমের খবরে, টকশোতে, চায়ের টেবিলে, ঘরে, বাইরে সব জায়গায়। এই ঘটনা কেন ঘটলো, কী কারণে ঘটলো, দেশে ধর্ষণের মাত্রা বাড়ছে না কমছে, আলোচিত ঘটনাটির বিচার হবে কী হবে না, সেসব বিষয়ে এই লেখা নয়। বরং ঘটনাটির পেছনে সমাজের অনেক অসঙ্গতির চিত্র যেমন লুকিয়ে রয়েছে, পাশাপাশি এই ঘটনা পরবর্তী ঘটনাবলিতে কিছু চরম সত্য আর অসঙ্গতির চিত্রও আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। তার বিশেষ কয়েকটি দিক তুলে ধারাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
এক. গণমাধ্যমের সজাগ দৃষ্টি এবং ধারাবাহিক প্রতিবেদনের কারণেই অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একটি জবাবদিহিতামূলক সমাজ বিনির্মাণে স্বাধীন গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা আর সততার যে বিকল্প নেই, সেটা আবারো প্রমাণিত হলো। দুই. গণমাধ্যমের পাশাপাশি অগণিত মানুষের প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক যে অনেক ইতিবাচক ভূমিকাও রাখছে তাও আর একবার প্রমাণ করলো।
তিন. অন্যদিকে আলোচিত ঘটনাটির খবর পরিবেশন করতে গিয়ে দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের দৈন্যদশাও দেখলাম আমরা। ধর্ষণের শিকার বলে আলোচিত দুই নারীর বাসার সামনে সাংবাদিকদের ভিড়, তাদের অবিকৃত কণ্ঠে অডিও সাক্ষাৎকার এবং ছবি প্রকাশ কোনোভাবেই সাংবাদিকতার নীতিমালার মধ্যে পড়ে না, যা এক্ষেত্রে করা হয়েছে। চার. গণমাধ্যমকে এই ঘটনায় যতটা সরব দেখা গেছে তার শতভাগের একভাগও দেখা যায়নি গাজীপুরে ধর্ষণের শিকার শিশুকন্যাকে নিয়ে একজন বাবার আত্মহত্যার ঘটনায়। শুধু গণমাধ্যম কেন? একই কথা প্রযোজ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনেক সংগঠন এবং বিশিষ্টজনদের আলোচনা আর কর্মকা-ে। দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে আরও অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মতো সংগঠন রাজপথে নেমে এলেও গাজীপুরের ঘটনায় এমন কিছু চোখে পড়েনি। গত ২৮ এপ্রিল রাজধানীর জুরাইন আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ১৫ বছরের এক কিশোরীকে সারারাত আটকে রেখে দল বেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার ক্ষেত্রেও আমরা এমন কিছু দেখিনি। রাজধানীর বনানীতে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় যখন দেশজুড়ে তোলপাড়, তখন রাজধানীতেই ঘটা একই ধরনের একটি ঘটনা থেকে গেল আড়ালে। এ সমাজের সবকিছু যে পুরোপুরি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত তা বুঝতে আর বেশি কষ্ট করতে হয় না। কারণ বনানীতে ঘটা ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আপন জুয়েলার্সের মালিকের মতো হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিকের সম্পর্ক। অথচ বনানীর ঘটনার চেয়ে তো অপর দুই ঘটনা আরও বেশি মর্মান্তিক।
পাঁচ. বনানীর ঘটনায় অভিযুক্ত আসামি সাফাত আহমেদের পিতা দিলদার আহমেদের প্রতিষ্ঠান আপন জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন ওঠার পর কর ফাঁকিসহ অন্যান্য দুর্নীতির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনিক বিভিন্ন দফতর। প্রশ্ন হলো, এত দেরিতে কেন প্রশাসনের এই তৎপরতা? সবই কি তবে লোক দেখানো? দিনের পর দিন সোনা চোরাচালানসহ যে ধরনের সংবাদ আমরা পাচ্ছি তার পেছেনে যে দেশের বড় বড় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশ রয়েছে তাতো অনেক পুরানো আলোচনা। ছয়. অবৈধ টাকার কাছে সব ধরনের অপরাধ আর দুর্নীতি করেও যে রেহাই পাওয়া যায়, তার ইঙ্গিতও মিলেছে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদারের দম্ভোক্তিতে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের দুই দিনের অভিযানে প্রায় ১৩ মণ স্বর্ণ উদ্ধারের পরও গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দিলদার বলেছেন, ৪০ বছর ধরে এ ধরনের অভিযান হলেও তিনি এগুলোতে পাত্তা দেন না।
সাত. শুধু আপন জুয়েলার্স কেন? অন্যান্য স্বর্ণ ব্যবসায়ীদেরকেও কেন এখনই নজরদারিতে আনা হচ্ছে না? কারণ দিলদারের দম্ভোক্তি অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নাকি তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে এ রকম অনেক ধর্ষণের ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? আট. দাবি উঠেছে আপন জুয়েলার্স বয়কট করার। আমার দৃঢ়বিশ্বাস এই প্রতিষ্ঠানটি পরতে পরতে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি আর অপকর্মের ঘটনা। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বয়কট করা বা বন্ধের মধ্য দিয়ে যে কয়েক হাজার কর্মজীবী মানুষের রুটি রুজি বন্ধ হয়ে যেতে পারে সে কথা আমরা বিবেচনায় আনছি না। কোনো প্রতিষ্ঠানে মালিকের অপরাধ থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সরকারের তত্ত্বাবধানে তা পরিচালিত হতে পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো অতি আবেগী দাবি কতটা সমীচীন তা বিবেচনার দাবি রাখে।
নয়. ধর্ষণের ঘটনাস্থল রেইনট্রি হোটেলে অবৈধভাবে মাদক রাখা হয় কি-না তা তদন্তে গিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা কিছু না পেলেও একদিন পর অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে বিদেশি মদ উদ্ধার করল শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। একই ঘটনায় সরকারের দুই সংস্থার বিপরীত চিত্র সংস্থাগুলোর কর্মকা-কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দশ. দিলদার তার গুণধর সন্তানের পক্ষ নিতে গিয়ে বলেছেন, ‘জোয়ান পোলা একটু আধটু তো করবই, আমিও করি…’। সমাজের মূল্যবোধ কোন তলানীতে গিয়ে ঠেকলে একজন পিতা তার সন্তানের পক্ষে এমন নির্লজ্জ সাফাই গাইতে পারে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
এগার. প্রথম দুদিন ওই ধর্ষণ ঘটনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে ঝালকাঠির এমপি বি.এইচ হারুনের পুত্র মাহির হারুনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও পরবর্তীতে সবাই যেন কুলুপ আঁটলেন। পুঁজিবাদী রাজনীতি অনেক কিছুই ঢেকে দিতে পারে, সে কথাই আমাদেরকে বুঝতে হলো আবার। বারো. সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে অন্য অনেক অপরাধকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা আমাদের মাঝে বিদ্যমান, তাতে সমাজকে আরও বেশি বিপদগ্রস্ত হতে হচ্ছে। দুই তরুণী ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগের পেছনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে কি-না, এমন প্রশ্ন সামনে আনতে আমরা ভয় পাচ্ছি। কারণ কেউ আবার ধর্ষকের পক্ষাবলম্বনকারী হিসেবে অভিযুক্ত না করে ফেলে! ভিষয়টি নিয়েও ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। এদেশে নারী নির্যাতনের পাশাপাশি এখন অনেক পুরুষও যে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে তা জানলেও অনেকে মুখে উচ্চারণ করতে চান না, পাছে প্রগতিশীলতা নষ্ট হয়। সমস্যার গভীরে গিয়ে রোগের সঠিক কারণ নির্ণয় করতে না পারলে মানবদেহের মতো পুরো সমাজের ধ্বংস অনিবার্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান