বিশেষ সাক্ষাৎকারে অপরাধ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ধর্ষণের মতো বীভৎস অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
আমরা একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কোর্ট, পুলিশ এবং জেল বা প্রিজন রয়েছে। আধুনিক জীবনব্যবস্থার সাথে সাথে যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তন বা আধুনিকায়ন করা না হয় তাহলে ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো রোধ করা যাবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বৃদ্ধি পাবে। নিরাপত্তা বাহিনীও এ ধরনের বীভৎস ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দমন করতে পারবে নাÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান।
তিনি বলেন, সমাজে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে তার প্রটেকশন দেওয়ার জন্য যে ধরনের পুলিশিং থাকা দরকার, যে ধরনের কোর্ট সিস্টেম থাকা দরকার তা এখনো আমাদের এখানে ডেভেলপ করেনি, যা ফলে এ জায়গাগুলো কাজ করতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা একটা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঢুকেছি। পুঁজিবাদের একটা হিউম্যান ফেস আছে। কিন্তু এই হিউম্যান ফেসটা আমরা আরলি স্টেজে দেখি না। এখন হঠাৎ করে প্রচুর মানুষের টাকাপয়সা হয়েছে। টাকাপয়সা কিভাবে ব্যবহার করবে তা হয়তো অনেকেই জানেন না। লোভ বেড়ে গেছে। যেটা আপন জুয়েলার্সের মালিকের বক্তব্যে পেয়েছি। মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে একাকার হয়ে গেছে। অর্থাৎ একদিকে আমাদের সনাতনি মূল্যবোধগুলো যেমন ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে, আরেক দিকে কিছু লোক অসাধুপায় ও নানাভাবে টাকাপয়সা উপার্জন করে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. জিয়া রহমান বলেন, সমাজে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সবারই প্রত্যাশা। সবাই চায়Ñ অন্যায়, অপরাধমুক্ত থাক সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশামতো সবসময় সবকিছু হয় না। ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটে। এখানে কিছু কিছু সামাজিক অপরাধ বেড়ে গেছে। জঙ্গিবাদী প্রবণতা, ধর্ষণের মতো বীভৎস ঘটনাও ঘটছে। তারও অনেক কারণ আছে। প্রধানতম কারণ হচ্ছেÑ আমাদের সামাজিক রূপান্তরটি ঘটছে আকর্ষিকভাবেই। সামাজিক এই রূপান্তরকে সমাজবিজ্ঞানে বলা হয়, কালচারাল লেক। অর্থাৎ এই যে আমাদের তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়া, গ্লোবালাইজেশনÑ সবকিছুকে আমরা আকাশ সংস্কৃতি বলে থাকি। আমাদের এখন ট্রেডিশনাল সোসাইটি থেকে মডার্ন সোসাইটিতে উত্তরণ ঘটছে। এটাকে আমরা রূপান্তর সময় বলি। সমাজ রূপান্তরের এই সময়ে একটা সামাজিক অস্থিরতা থাকে। একটা সময় সেটা ঠিক হয়ে যাবে বলে আমরা ধারণা করছি।
তিনি বলেন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার আমরা করছি ঠিকই, কিন্তু কিভাবে তা ব্যবহার করতে হয় তা হয়তো এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্যও একটা সুনির্দিষ্ট সময় লাগবে। এটা ফ্রি মিক্সিং। এই যে আমাদের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে মিশছে, মেয়েরা বিভিন্ন পার্টিতে যাচ্ছে, কেউ কেউ ধূমপানও করছে। এ সবই উত্তরণের একটা ট্রানজিশনাল ফেস।
১৯২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বনানী ধর্ষণের মতো একটা ঘটনা ঘটেছিল, যখন প্রচুর শিল্পায়ন হচ্ছিল, অভিবাসীরা ঢুকছিল, সেই সময়ে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। এটাকে আমরা কালচারাল লেকের থিউরি দিয়ে ব্যাখ্যা করি। যেটাকে আমরা বলছি, অবস্তুগত সংস্কৃতি। পরিবারের বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়া, আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তা চর্চা করা। একটা নতুন কিছু আসছে আমাদের কাছে, কিন্তু তা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছি না আমরা। গ্রহণ করছি বিকৃতিভাবে। যেকোনো সমাজের উত্তরণের সন্ধিক্ষণে এ ধরনের ঘটনা ঘটবেই। ইতিহাস তাই বলে।
তিনি আরও বলেন, দুনিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখব, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই অনেক সমাজ এগিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অত্যন্ত ভালো। উঁচু মানের। তবু প্রতি দুই মিনিটে সেখানে একটা করে ধর্ষণ হয়। কোনো ঘটনার পর হঠাৎ করে আমরা যারা মায়াকান্না করে দিই যে, দেশ শেষ হয়ে গেল, সমাজ নষ্ট হয়ে গেল, এমনটি করা কতটা সঠিক? এ বিষয়ে সামাজিক অবস্থান থেকে যদি বলি তাহলে বলব, এটা একটা জেনারেল প্রসেস। এই প্রসেসের উত্তরণ ঘটার জন্য দীর্ঘ সময় লাগে। আমরা যদি আমাদের জনসংখ্যার সংখ্যা দেখি, নগরবাদ ও অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবÑ আমাদের মধ্যে ডেভেলপ করেনি, মানুষকে আমরা শ্রদ্ধা করতে শিখিনি। অপরাধ দমন নিরাপত্তা বাহিনী বা পুলিশের কাজ। এটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা যদি নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যার রেসিও দেখি, তাদের কাজ দেখি, যদি নির্মোহভাবে বলি তাহলে বলব ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ কোনো ঘটনাই না। তবে এমন করে তো আর বলা যাবে না। কারণ আমরা তো ধর্ষণের মতো এমন বীভৎস কর্মকা-কে সমর্থন করি না। করতে পারি না কোনোভাবেই। এ সমস্ত অপরাধকে আমরা অবশ্যই নেতিবাচকভাবে দেখি। এমন পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতেই আমরা চাই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, মডার্ন সোসাইটিতে একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র ডেভেলপ করেছে। রেনেসাঁ, শিল্পায়ন, নগরায়নের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা খর্ব হয়ে গেছে। বিশাল একটা সিভিল সোসাইটি সেসব সমাজে তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোসাইটিতে সিভিল সোসাইটির বিরাট একটা রোল আছে। ওমেন্স অরগানাইজেশন, লেবারদের অরগানাইজেশন, পেশাজীবীদের অরগানাইজেশন, সমাজ বিনির্মাণে তাদের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এগুলো একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। প্রত্যেকটা অরগানাইজেশনের একটা লবিস্ট রয়েছে। কংগ্রেশনাল হেয়ারিংগুলোতে তাদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে। ষাটের দশকে সেখানকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটা গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়ার জন্য একের পর এক সোশ্যাল মুভমেন্ট হয়েছে, ওমেন্স লিবারেশন মুভমেন্ট, ব্ল্যাক সিভিলাইজড মুভমেন্ট, এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট, গ্রে লেজবিহান মুভমেন্টসÑ এ অধিকারগুলো অর্জনের জন্য ওই যে সিভিল সোসাইটি ডেভেলপ করেছে তারা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তার ফলে মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। একটা চাপ তৈরি হয়েছে। তার ফলে নতুন নতুন মডার্ন আইন তৈরি হয়েছে। অ্যাক্সিকিউশনের জন্য যে ইনস্টিটিউশন প্রসেস সেই প্রসেসগুলোও কাজ করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনো কোনো সিভিল সোসাইটি ডেভেলপই করেনি। রাষ্ট্র অত্যন্ত শক্তিশালী। আর্থিকভাবে শক্তিশালী গ্রুপের সঙ্গে পুলিশের একটা অশুভ আঁতাত তৈরি হয়েছে। টাকাপয়সা দিয়ে যেন তারা সমস্ত কিছুকে কিনে ফেলেছেন! ফলে সাধারণ মানুষের অধিকার তো প্রতিষ্ঠিত হয়নিই, নারী, শিশুদের উপর থেকে থেকে নির্যাতনের ঘটনাগুলো দেখছি। আমাদের কাছে এখন রক্ষাকবচ একটাইÑ সামাজিক আন্দোলন। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যত কথাই বলিÑ এটা করতে হবে, ওইটা করতে হবে, রাষ্ট্র কেন করছে না সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু এ সমস্ত সমস্যা থেকে যদি বের হয়ে আসতে হয় তাহলে আমাদের একটা সামাজিক আন্দোলন ডেভেলপ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন গ্রুপের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই। আমাদের এই অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করার জন্যও আন্দোলন দরকার। ধর্ষণের মতো বীভৎস অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। আমাদের এখানে ইতোমধ্যেই এটা শুরু হয়ে গেছে। সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নামছে। আমি খুব আশাবাদী। কারণ আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেই রাজন, রাকিব, খাদিজা বা বিশ্বজিৎ হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বিচার খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়েছে। এখানে জনসচেতনতা খুব কাজ করেছে বলে মনে হয় আমার। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তনু, সাগর-রুনি ও পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার বিচার এখনো করতে পারিনি।
তবে আমরা আশা ছাড়ছি না। এই আশাবাদের কারণ আমাদের ২৬টি বা তার চেয়েও বেশি টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। শক্তিশালী প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া আছে। ‘তালাশ’ কিংবা ‘৩৬০ ডিগ্রি’র মতো জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান হচ্ছে, যার মধ্যে দিয়ে একধরনের জনসচেতনতা তৈরি হচ্ছে। একধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে রাষ্ট্রের উপর। এই জনসচেতনতা দিন দিন বাড়ছে বলেই রাজন-রাকিব হত্যার বিচার খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এখন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলের কি হবে আমরা জানি না। কারণ তার অনেক টাকাপয়সা আছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের কাছ থেকে একজন সাধারণ মানুষ কতটুকু সমর্থন পাবে সেটাও জানি না।