তত্ত¦াবধায়ক সরকারের সময় নেওয়া ব্যবসায়ীদের টাকা ফেরতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
এস এম নূর মোহাম্মদ : সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরতের বিষয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে ৮৯ পৃষ্ঠার এ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। এর আগে গত ১৬ মার্চ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ৪ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের করা আপিল খারিজ করে ওই রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বলা হয়, ডিজিএফআই দেশের একটি স্বাধীন সংস্থা এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে তাদের কর্মকা- স¤পূর্ণ আলাদা। নির্বাহী বিভাগের মতো তারা কাজ করতে পারে না। আবার বেআইনি কাজও তারা বৈধতা দিতে পারে না। এতে বলা হয়, কোন ক্ষমতাবলে এবং কিভাবে তারা টাকাগুলো উদ্ধার করে বা জোরপূর্বক নেয় তার ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। সরকার নীরব থেকেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং তার প্রধান নির্বাহী এ অনৈতিক ও অমানবিক কাজকে সমর্থন করেছে।
রায়ে আরও বলা হয়, বিশেষ পরিস্থিতি কিংবা জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো পরিস্থিতিতে সরকারি সংস্থা বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা ডিজিএফআইকে আইন বহির্ভূতভাবে জনগণের জীবন, সম্পদ ও ব্যবসায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
সেনাবাহিনী সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, সেনাবাহিনী আমাদের দেশের সম্পদ। সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক কাজ হচ্ছে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও দেশের সীমান্তের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। দেশের ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় এবং আইনের শাসন রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখা। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রকে দুই ধরনের সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। প্রথমত: রাজনীতিবিদ, যাদের সামরিক উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে এবং দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে সামরিক বাহিনীতে থাকেন তাদের থেকে দেশকে রক্ষা করা।
এতে বলা হয়, কিছু উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যায়। আইন বহির্ভূতভাবে কিছু সেনা কর্মকর্তা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকে। রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়ের কথা তুলে ধরে বলা হয়, ওই রায়ে আদালত সামরিক আইন জারিকে অনুমোদন দেয়নি। আদালত এদের (সামরিক আইন জারিকারী) বেআইনি কাজের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে বলেছে। যাতে অন্যায়কারীরা জনগণের অধিকার খর্ব করার সাহস না দেখায়।
ওই রায়ে আদালত বলেছিল, সংবিধান বহির্ভূত কাজ চিরদিনের মতো বিদায় দিতে সংসদ আইন করতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী করেছে। এতে ৭ক নামে একটি অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কেউ সংবিধান বহির্ভূতভাবে এ জাতীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে বা সংবিধান স্থগিত করে তবে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এটা একটা অনন্য ব্যবস্থা। যা ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, দক্ষিণ আফ্রিকা বা উন্নয়নশীল কোনো দেশে নেই।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে আপিল বিভাগে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম ও খায়রুল আলম চৌধুরী। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম। সে সময় আহসানুল করিম বলেন, যারা টাকা ফেরত চেয়ে আদালতের দারস্থ হয়েছেন প্রথমে তারাই এই সুবিধা পাবেন। অন্যদের টাকা ফেরত পেতে আদালতে আবেদন করতে হবে।
এর ফলে এখন ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফেরত পেতে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এর আগে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হয়। সে সময় ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে প্রায় ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১২৩২ কোটি টাকা নিয়ে দুই শতাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়।
পরবর্তীতে ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থ ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে পৃথক ১১টি রিট আবেদন করেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। রিট আবেদনকারীরা হলেন ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ১৮৯ কোটি, বসুন্ধরা পেপার মিল লিমিটেড ১৫ কোটি টাকা, মেঘনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ৫২ কোটি, এস. আলম স্টীল লিমিটেড ৬০ কোটি টাকা, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড ৩৫ কোটি টাকা, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড ১৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড ৯০ লাখ টাকা, ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড ৭০ লাখ টাকা, ইউনিক গ্রুপের মালিক নূর আলী ৬৫ লাখ টাকা এবং দি কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেড ও বারাউরা টি কোম্পানি লিমিটেড ২৩৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
এসব রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই টাকা তিনমাসের মধ্যে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। তবে বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্টের দেওয়া এ রায় স্থগিত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আবেদন করলে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। পাশাপাশি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আবেদন করতে বলা হয়।
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের করা লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে আপিল বিভাগ ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংককে আপিল করার অনুমতি দেন। এরপর আপিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার ওপর শুনানি শেষে গত ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের আপিল খারিজ করে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। সম্পাদনা : হুমায়ুন কবির খোকন