বৃদ্ধাশ্রম, অপসংস্কৃতি এবং আমাদের দায়িত্ববোধ
ডা. জাকির হোসেন
কিছুদিন ধরেই পত্রিকাগুলোতে বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করা মা-বাবাদের আকুতিভরা করুণ জীবনের কাহিনী তুলে ধরছে। প্রতিটি লেখা পড়ার মতো সাহস দেখাতে পারিনি। প্রতিটা মা-বাবার করুণ জীবন কাহিনী মনে হয়েছে একেকটি করুণ ছায়াছবির গল্পের মতো। সময়ের প্রয়োজনে ভেঙে গেছে একান্নবর্তী পরিবার। গড়ে উঠেছে ছোট ছোট একক পরিবার। আকাশসংস্কৃতির পুরোপ্রভাব পড়তে শুরু করেছে একক পরিবারগুলোতে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি বৃদ্ধাশ্রমগুলো সরকারিভাবে গড়ে উঠেছিল তাদের সিনিয়র সিটিজেনদের মৌলিক চাহিদাগুলো যথাযথভাবে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। কারণ তাদের সংস্কৃতিতে আমাদের মতো একান্নবর্তী পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন মিলেমিশে বসবাসের রীতি ছিল না। আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। দেশে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠার পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল।
আমাদের সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত নারী-পুরষদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছিল। যাদেরকে লালন পালন করার মতো কোনো আপনজন ছিল না কিংবা আপনজন থাকা সত্ত্বেও তাদের লালন পালন কিংবা ভরণ পোষণ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না মূলত এই সকল সুবিধাবঞ্চিত বয়স্ক নারী-পুরুষদের পুনর্বাসনের জন্যই বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকার পাতায় যে সকল বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের জীবন কাহিনী তুলে ধরেছেন, তাদের শোনা গল্প থেকে মনে হয়নি তারা যে সকল পরিবার থেকে এসেছেন সেখানে তাদের ছেলেমেয়েরা আর্থিক কষ্টে আছেন। অনেকের ছেলেমেয়েরা সমাজে খুব সুনামের সহিত প্রতিষ্ঠিত। যৌবনে এই সকল বাবা-মা নিজের জীবনের সবটুকু সময়, ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তাদের শেষ বয়সের ভরণ-পোষণের জন্য পাচ্ছেন না। অনেক স্বচ্ছল পরিবারে বয়স্কদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। নানা অজুহাতে নিজের পিতা-মাতাকে তারা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে চলে আসছেন। এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে, একবার মা-বাবাকে বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সব দায়মুক্তি। অনেক নামি-দামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা একসময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছে। বেশির ভাগ সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন আর তাদের কোনো খোঁজ-খবরও নেন না, তাদের দেখতে আসেন না, এমনকি প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা বা জিনিসপত্রও পাঠান না। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে বা ঈদের আনন্দের সময়ও বাবা-মাকে বাড়িতে নেন না। একটা অপসংস্কৃতির প্রভাব আর কুশিক্ষার বিস্তারে বাঙালি সমাজের গৌরবময় সংস্কৃতিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পরিবারে ছোট ছেলেমেয়েগুলো দাদা-দাদী এবং নানা-নানীর আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ছোট ছেলেমেয়েরা এখন আর পরিবারে খেলার সাথী খুঁজে পাচ্ছে না। তাদেরকে গল্প শোনোর কেউ আজ পরিবারে নেই। বঞ্চিত হচ্ছে মূল্যবোধ শেখার পারিবারিক শিক্ষা থেকে। এই কুফল থেকে বের হয়ে আসতে হলে সবাইকে সচেতন হওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। মনে রাখতে হবে, জীবনের ব্যস্ততার অজুহাতে বয়স্ক মা-বাবাকে অবহেলা করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তিনিই যিনি কাজ করছেন। মা-বাবার প্রতি আমাদের ভালোবাসা হোক নিখাদ, সুদমুক্ত, বিতর্কমুক্ত। তারা বাঁচুক সীমাহীন আনন্দে।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান