আত্রাই নদ সমাচার
শেখ মিরাজুল ইসলাম
খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে দুই প্রধান সুমেরীয় নগর লাগাশ ও উম্মার মধ্যে তাইগ্রিস নদীর শাখা-প্রশাখার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পানি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। হাজার বছর পর একই অঞ্চলে ইউফ্রেটিস নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে তুরস্ক ‘দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় আনাতোলিয়ান প্রজেক্ট’ হাতে নিয়েছে। যার ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৬০% পানি প্রবাহ তুরস্কের দখলে চলে যাবে। পানি বঞ্চিত হয়ে কৃষি-শিল্পায়নে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে সিরিয়া ও ইরাক।
এর আগে ১৯৬৭ সালে জর্ডান নদী ও ইয়ারমুক নদী দুটোর দখল নিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে সিরিয়া এবং জর্ডানের ছয়দিনের এক সংক্ষিপ্ত ‘পানি-যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছিল। যা এখনো অমীমাংসিত। আফ্রিকায় কঙ্গো নদী, নাইজার নদী, রাইন নদী, নীল নদ অনধিক এগারটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে সভ্য-ভব্য নদী হচ্ছে ইউরোপের দানিউব। মাত্র ঊনিশটি দেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হলেও এই নদীর ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কারও সঙ্গে কারও বিবাদ নেই। তুলনায় গাঙ্গেয় উপত্যকায় আছি আমরা মাত্র দুটি দেশ। কি বিশাল ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা আমাদের! অথচ নদীর ন্যায্য হিস্যা নিয়ে একপেশে অসভ্যতা। ফারাক্কা বাঁধকে কেন্দ্র করে পদ্মা-তিস্তার সীমিত প্রবাহ শুধু ভূ-প্রকৃতি নয়, বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে এই অলিখিত পানি-যুদ্ধ সুরাহা হওয়ার লক্ষণ নেই। শুকনো মৌসুমে এই বিষয়ে আলোকপাতের কারণ হচ্ছে, আরেকটি সীমান্তবর্তী ছোট নদ নিয়ে নতুন করে ‘ঝামেলার’ সূত্রপাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। যদিও টক-শো বা মিডিয়ায় তা নিয়ে উঁচু গলায় আলোচনা এখনো শুরু হয়নি।
আত্রাই নদ। গতিবিধি অনেকটা ব্রহ্মপুত্রের মতো। ভারতের শিলিগুড়ি পাহাড় বনাঞ্চল হতে উৎপত্তি হলেও সমতলে বাংলা মাটির সেবায় যেন নিবেদিত। এর সিংহভাগ প্রবাহ আমাদের দেশের ভিতর দিয়ে। দিনাজপুর পেরিয়ে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকায় মাত্র ৩২ মাইল ঢুঁ মেরে আবার রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলে চলনবিল হয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ মাইলের যাত্রাপথ। পদ্মায় আত্মসমর্পণ।
বাংলাদেশের দিনাজপুর অংশে ছোট্ট একটা রাবার ড্যাম দিয়ে শুকনো মৌসুমে স্থানীয় চাষীরা কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ফলান। তৃণমূলের মমতা দিদির অনেক রাগ সেই ড্যামের উপর। তাদের দাবি, যার কারণে পশ্চিমবঙ্গের ৩২ মাইলের চাষীরা আত্রাই-এর স্রোতস্বিনী ধারা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আত্রাই বাঁচাও’ আন্দোলন। মমতা ব্যানার্জীর সরকার রাবার ড্যাম প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ করছেন দিল্লি কেন্দ্রীয় সরকারের উপর। যদিও বাংলাদেশের তরফ হতে দেখানো হয়েছে সেই রাবার ড্যামের কারণে নিম্নমুখী প্রবাহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারণ নদটির বাকি অংশ বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় দিল্লি সরকার এই ব্যাপারে আমাদের উপর কি ধরনের পাল্টা চাপ প্রয়োগ করে। ফলাফল যাই হোক, বাকি নদীগুলোর মতো আত্রাই ধর্ষিতা হোক তা মেনে নিতে পারব না।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান