সংবিধানে নিষিদ্ধ হলেও জুয়া বাধাহীনভাবে চলছে
ইকতেদার আহমেদ
বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল নীতিসমূহের অন্যতম একটি হলো জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা। জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর এমন সকল কাজ সংবিধানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জুয়া খেলা একটি অনৈতিক কাজ। জুয়া খেলা বিষয়ে সংবিধানে বলা হয়েছেÑ জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। জুয়া বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে যেমন তাস দিয়ে জুয়া খেলা, ঘোড় দৌড়ের বাজির মাধ্যমে জুয়া খেলা, ক্রিকেট, ফুটবল প্রভৃতি খেলায় কোন দল জিতবে এ নিয়ে বাজি ধরা, কেসিনোতে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলা, হাউজির মাধ্যমে জুয়া খেলা প্রভৃতি। উপরোক্ত সকল ধরনের জুয়া খেলাই আমাদের সংবিধান এবং দেশে প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো রাজধানী শহর ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ হতে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই জুয়া খেলা চলছে। রাজধানী শহর ঢাকায় যে সকল অভিজাত ক্লাব রয়েছে এর প্রত্যেকটিতে তাসের মাধ্যমে জুয়া খেলা চলে। আবার কোনো কোনোটিতে হাউজির মাধ্যমেও জুয়া খেলা চলে। বিভিন্ন জেলা শহরে সরকারি বেসরকারি যে সকল ক্লাব রয়েছে এগুলোর প্রতিটিতেই তাসের জুয়া খেলা চালু রয়েছে।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রেসকোর্স নামে পরিচিত ছিল। সে সময় এ উদ্যানটিতে প্রতি রোববার ঘোড় দৌড়ের জুয়া খেলা অনুষ্ঠিত হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ঘোড় দৌড়ের জুয়া খেলা বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠ অবদান রাখেন। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও আগ্রহে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে জুয়া খেলা অনৈতিক বিধায় এটি নিষিদ্ধ করা হয়।
দেশের সর্বত্র বর্তমানে অপ্রতিরোধ্যভাবে তাসের জুয়া খেলার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তসহ সকল শ্রেণিপেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ জুয়া খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্তমানে বাসা-বাড়ি, হোটেল, মেস, ছাত্রাবাস, ডর্মেটরি প্রভৃতি ছাড়াও হাটে, ঘাটে, মাঠে ও নির্জন স্থানে জুয়া খেলা চলে। এমনকি রেল স্টেশন, বাস স্টেশন, বিভিন্ন বাজার, বাস, লঞ্চ, স্টিমার প্রভৃতির অভ্যন্তরে জুয়া খেলা চলে। গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় অনেকে জুয়া খেলায় মত্ত থেকে সময় কাটায়।
যারা জুয়া খেলে বা জুয়া সংশ্লেষে বাজি ধরে এদের জুয়াড়ি বলা হয়। জুয়াড়ি তিন ধরনের। এর একটি হলো উচ্চবিত্ত। এদের অর্থকড়ির কোনো অভাব নেই। এরা জুয়া খেলে লক্ষ টাকা জিতলে বা হারলে এ কোনোটিই তাদের আর্থিক ভিতকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে না। এ সকল উচ্চবিত্তরা জুয়া খেলাকে সময় কাটানোর একটি উপলক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করে। আর অপর দুটি শ্রেণির একটি হলোÑ অভ্যাসগতভাবে জুয়াড়ি আর অপরটি মাঝে মাঝে বিশেষত ছুটির দিন ও অবসর সময়ে জুয়া খেলে থাকে। অভ্যাসগত জুয়াড়িরা পকেটে টাকা আছে কি নেই তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। এরা একবার জুয়া খেলায় বসে ক্রমাগতভাবে হারতে থাকলেও দেখা যায় অপর জুয়াড়িদের থেকে ধারকর্জ করেও খেলা অব্যাহত রাখে। জুয়া খেলায় হার-জিৎ থাকায় উভয়টি সমন্বয় করলে দেখা যায় অধিকাংশের হারের পাল্লাই ভারি। অভ্যাসগত জুয়াড়িদের অনেকে জুয়া খেলতে গিয়ে ভিটে মাটিহারা হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন এমন নজির সর্বত্র রয়েছে। অভ্যাসগত জুয়াড়িদের মধ্যে অনেকে হেরে যখন শূন্য পকেটে ঘরে ফিরেন তখন স্ত্রীর উপর চড়াও হতে দেখা যায়। এদের মধ্যে একটি অন্ধ বিশ্বাস কাজ করে তারা খেলায় মত্ত থাকাকালীন স্ত্রীর অভিশাপের কারণে হারের ঘটনা ঘটেছে। আর তাই ঘরে ফিরে স্ত্রীকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে হারের মনোব্যথা হালকা করার চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য অভ্যাসগত জুয়াড়িদের খেলায় মত্ত থাকার বিষয়টি সম্পর্কে তাদের স্ত্রীদের সম্যক ধারণা থাকে।
ছুটির দিন ও অবসর সময়ে যারা জুয়া খেলে এদের অনেকে শখের বসে জুয়া খেলে। এদের মধ্যে সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছে। এ ধরনের জুয়াড়িরা হারের মধ্য দিয়ে বড় অংকের অর্থ খোয়ালে তাদের মাসের অবশিষ্ট অংশ ধারকর্জ করে চলতে হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রাবাসসমূহে এক শ্রেণির ছাত্রের মধ্যে জুয়া খেলার নেশা এত ব্যাপক যে তারা সারারাত জুয়া খেলে দিনের অধিক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। আর এভাবে দেখা যায় ক্লাসে উপস্থিত হওয়া ও পড়ালেখার চেয়ে জুয়া খেলার প্রতি তাদের অধিক আগ্রহ। মেসে বসবাসকারী কিছু ছাত্রের মধ্যেও এ প্রবণতাটি লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ রয়েছে। এ সকল শ্রমজীবী মানুষরা মেস বা বস্তি বা নিম্নভাড়ার বসতবাড়িতে থাকে। শ্রমজীবী মানুষেরও একটি অংশ এমনভাবে জুয়া খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে যে নিজ নিজ কাজ শেষে নিজেদের পছন্দমতো স্থানে এরা জুয়া খেলায় মত্ত হয়। জুয়া খেলায় যিনি জিতেন তিনি খেলা ভেদে যে অংকের টাকাকে ভিত্তি ধরে খেলাটি পরিচালিত হয় কমপক্ষে তার দ্বিগুণ অথবা কয়েকগুণ অধিক অর্থ পেয়ে থাকেন। আর যারা হারেন তাদের ব্যয়ের সম্পূর্ণটুকই খোয়া যায়।
জুয়া খেলা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ বিধায় পাপ হিসেবে গণ্য। একজন ইমানদার মুসলিম সবসময় নিজেকে জুয়া সম্পৃক্ত খেলা হতে দূরে রাখতে সচেষ্ট থাকেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৯০ ভাগের অধিক মুসলিম। জুয়া খেলা ইসলাম ধর্মে ও বাংলাদেশের সংবিধানের নিষিদ্ধ বিধায় কোনোভাবে এ খেলাটিকে বাংলাদেশের কোনো স্থানে চলতে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ সময় কাটানোর জন্য অর্থের সম্পৃক্ততা ছাড়া তাস খেললে সেটি জুয়ার পর্যায়ে পড়ে না। এ ধরনের তাস খেলা সাধারণত পারিবারিক পরিম-লে এবং বনভোজন, ভ্রমণ প্রভৃতিতে থাকাকালীন হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে বর্তমানে অর্থের সম্পৃক্ততায় বিভিন্ন ধরনের যে জুয়া খেলা হয় তা একদিকে অনৈতিক অপরদিকে দেশের সংবিধান ও আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। আর তাই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আবশ্যিক কর্তব্য এ ধরনের জুয়া খেলা যেন কোনোভাবে চলতে না পারে সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা। কিন্তু এরা যথাযথভাবে সচেষ্ট নয় বলেই আজ দেশের সর্বত্র বাধাহীনভাবে জুয়া খেলা চলছে।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ব-সধরষ: রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান