ভোট-জোট এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন
গোলাম মোর্তোজা
২০১৮ সালের শেষের দিকে আগামী জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের গণতন্ত্র এখন খুবই সংকটময় অবস্থায় আছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছিল তা প্রতিহত করতে গিয়ে যে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল বিএনপি-জামায়াত, তা ছিল ভয়ঙ্কর। তারা যতই বলুক যে ‘আমরা করিনি’ দায়মুক্ত হওয়া যাবে না। আন্দোলন যেহেতু তারা করেছিল, দায়ও তাদের নিতেই হবে। আবার সুষ্ঠু নির্বাচন করার দিকে মনোযোগ না দিয়ে, গুলি করে মানুষ হত্যা করে দমন করেছিল, তাও সমর্থনযোগ্য ছিল না। সরকারের এই দমন আচরণও মানুষ গ্রহণ করেনি। ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে আমাদের গণতন্ত্র বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। দেশে এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে প্রায় কিছুই আর অক্ষুণœ নেই। এমন একটি অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন আসছে। সবাই প্রত্যাশা করছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। মানুষ তার ভোট দিতে পারবে। ভোটের অধিকার থাকবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে মানুষের সেটা আর নেই। এ রকম একটা জায়গা থেকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করছে, তাদের নির্বাচনি তৎপরতা আমরা দেখছি। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ জোট গঠন করেছে। এমন আরও অনেকে জোট গঠন করছেন কিংবা গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে তোয়াজ করার রাজনীতি এখন দৃশ্যমান। কোনো দেশে যখন সুস্থধারার রাজনীতি থাকে না, তখন এ রকম জোট বা জোটকেন্দ্রিক রাজনীতি দেখা যায়। বর্তমানেও দেশে তা দেখা যাচ্ছে। দেশে যদি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে এ ধরনের জোটের কোনো গুরুত্ব থাকবে না। আর যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয় তাহলে এই জোটের গুরুত্ব থাকবে। এ জোটগুলোর কোনো ভোট নেই, কিন্তু এরা একটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ থাকতে চায়। এরা সবাই প্রত্যাশা করে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে জোট করে যেকোনো উপায়ে বিরোধী দল হতে চায়। এ ধরনের গৃহপালিত বিরোধী দল একসময় আ স ম আব্দুর রব ছিলেন, এরশাদের সময়ে। আর এখন এরশাদ আছেন আওয়ামী লীগের সময়ে। এটা দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ধরনের জোট রাজনীতির জন্য ইতিবাচক কোনো ঘটনা নয়। রাজনীতির জন্য ইতিবাচক ঘটনা হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন করবে। কিন্তু তাদেরকে সহায়তা করতে হবে সরকারকে। আমরা প্রত্যাশা রাখি, সরকারের সহায়তায় নির্বাচন কমিশন তার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন উপহার দিতে পারবে।
সুস্থধারার বিকাশমান একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কারণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে। সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কোনো শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা, আশ্রয় দেওয়া, সাম্প্রদায়িক কোনো শক্তিকে নিজের সঙ্গে নেওয়া উচিত নয়। সেটা আওয়ামী লীগ, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী যেকোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাদের কারোরই উচিত হবে না ভোটের রাজনীতি বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তাদের সঙ্গে নেওয়া। বর্তমানে আওয়াী লীগ হেফাজতকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, আরও আগে থেকেই বিএনপি জামায়াতকে প্রশ্রয় দিয়েছে। অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছে। বড় দুটি রাজনৈতিক দল যে প্রক্রিয়াতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তাতে বাংলাদেশের ইতিহাস অত্যন্ত বিপজ্জনক দিকে মোড় নিচ্ছে বলে আমার ধারণা। বিপজ্জনক এই জায়গা থেকে হুট করে বেরিয়ে আসবে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোনো আলামত বা ইঙ্গিতও আমরা দেখছি না। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তার বিষয়। বড় রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যখন দৃশ্যমানভাবে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করছে, তখন জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি মেলা দূরাশা ছাড়া আর কিছু নয়।
পরিচিতি: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ/সম্পাদনা: আশিক রহমান