সাধারণ মানুষের বাজেট ভাবনা
মিল্টন বিশ্বাস
প্রতিবছর জুন মাসে সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পর সেই বাজেটকে সময়োপযোগী বলে উল্লেখ করা হয় কিংবা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা বাজেটকে অভিনন্দন জানিয়ে রাস্তা মাথায় করে নাচে আর সেখান থেকে বলা হয় দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই এ বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে, এ বাজেট গণমুখি। অন্যদিকে বিরোধী দল বাজেটের বিরোধিতা করে হরতাল-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে। আর উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে গণমাধ্যমে চলে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। বাজেটের পর কিছু জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি পায় আর কিছু জিনিসের দাম কমবে বলা হলেও আদৌ কমে কিনা সন্দেহ থেকে যায়। বাজেট কেন্দ্রিক এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গ্রামের গৃহস্থ ও শ্রমজীবী আর শহরের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গের জীবন বয়ে চলে।
সাধারণ মানুষের কাছে দেশের উৎপাদন, ঘাটতি, আয়-ব্যয় প্রভৃতি ব্যাপারগুলো খুব একটা স্পষ্ট নয়। উপরন্তু তাদের কাছে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বাজেট প্রণয়ন করা হয় কিনা তাও পরিষ্কার নয়। সরকারের ঘোষিত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে শতভাগ সফলতা অর্জিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাজেটের গুরুত্ব কী সে বিষয়েও তারা ততটা সচেতন নয়। সব মিলিয়ে বলা চলে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও কল্যাণকামী দেশ গড়ার পথে বাজেট নিয়ে সরকারের ভাবনা-চিন্তার অংশীদারি তারা নয়। মানুষের সার্বিক কল্যাণকে মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে কিনা সে ভাবনা না থাকলেও সাধারণ মানুষের গার্হস্থ্য জীবনে বাজেটের অনিবার্য প্রভাব রয়েছে। অনেক সময় বাজেট ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব করে তুলতে পারে, দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে কিংবা ধনবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য অথবা সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। আবার বাজেট দেশের অর্থনীতিতে বিদেশের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করে জাতির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিম-লে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও নাজুকতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে দেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন থাকে তাহলেই সরকার বাজেট বাস্তবায়নে সফল হবে বলে আমাদের অভিমত।
পূর্বেই বলা হয়েছে, গার্হস্থ্য জীবনে বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রাম কিংবা শহরবাসী মধ্যবিত্ত চিন্তা করেÑ এবারের বাজেটে আয়করে ছাড় বাড়বে কিনা? রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য বাড়ছে কিনা? পরিষেবা করের আওতায় যেন নতুন করে আর কোনো পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত না করা হয়; মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যবস্থা নিক সরকার; বাজেট উপস্থাপনের আগে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে কোনো বাড়তি বোঝা না চাপিয়ে বাজেট হবে গণমুখি ইত্যাদি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকের মনে আয়কর ছাড় সংক্রান্ত ঘোষণা নিয়ে আগ্রহ থাকে। কেউ কেউ মনে করেন বর্তমানে যেখানে বার্ষিক দুই লাখ আশি হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করলে কর দিতে হয় না, সেখানে আগামী বাজেটে আয়ের সীমা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা উচিত। তাহলে এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সাধারণ চাকরিজীবীদের একটু স্বস্তি আসে। কিন্তু শুধু আয়করে ছাড় নয় যে মধ্যবিত্ত নিজের জমানো টাকা দিয়ে কষ্ট করে একটি গাড়ি কিনেছেন তিনি চাইবেন সিএনজি, অকটেন, পেট্রোল, ডিজেলের দাম যেন কম থাকে। আর বছরে ভর্তুকি এমন পরিমাণ থাকা দরকার তা যেন বিদ্যুতের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব মানুষের তো ইনডাকশন কুকার বা মাইক্রোওভেন কেনার ক্ষমতা নেই। তবু বিদ্যুতের বিল বেশি এলে চাপটা মাসের কাঁচাবাজারের ওপর পড়ে। (চলবে-০১)
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান