বিএনপিকে জাগিয়ে তোলার এজেন্ড কে বাস্তবায়ন করছে?
আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে মাঝে মধ্যে এমন কিছু ঘটনা হঠাৎ ঘটতে দেখি যেগুলোর যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ বা ব্যাখ্যা যারা সেসব ঘটান তারা দিতে পারছেন না, আমরাও খুঁজে পাই না, নিজেদেরকে তখন বোকা ভেবে সান্ত¡না দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার আমাদের থাকে না। এমনটি যারা ঘটান তারা আসলে নিজেদের কোনো না কোনো সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য বাস্তবায়নের এজেন্ডা থেকেই এমনটি করে থাকেন, যা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে অনেক বছরও অপেক্ষা করতে হয়। গত শনিবার সকালে হঠাৎ বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে পুলিশের তল্লাশি চালানো, কিছু না পাওয়া, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে আদালতের পরোয়ানা নিয়েই পুলিশের তল্লাশি চালানো সরকারের উপরের মহলের নির্দেশে পুলিশের তল্লাশি চালানো ইত্যাদি কথাবার্তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এসবের কোনোটাই এমনকি সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছেও সন্তোষজনক বলে মনে হয়নি। পুলিশের তল্লাশি শেষ হওয়ার আগেই বিএনপির বেশ কজন নেতা গুলশান কার্যালয়ে ছুটে গেছেন, গণমাধ্যমে খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির কর্মীরা কার্যালয়ের আশেপাশেই জড়ো হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে থাকে। দেশের অন্যান্য স্থানেও তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে, তারা রোববার দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করেছে, রাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ জরুরি সভা করে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। পুরো বিষয়টি দেশের রাজনীতি সচেতন মহলকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিস্মিত করেছে। সরকারের উচ্চ মহলের নির্দেশে পুলিশ নিষ্ফল অভিযান চালিয়েছে, এতে দোষ বা দায়টা পুলিশের নয়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওপরই গিয়ে পড়েছে, পুলিশ বরং দায় থেকে মুক্ত থেকেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়া নির্দেশের প্রেক্ষিতে পুলিশ যে তল্লাশি চালিয়েছে তার ফলাফল শুধু শূন্যই নয়, সরকারের জন্য যথেষ্ট নেতিবাচক হয়েছে। যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যেত তাহলে বিএনপির প্রতিবাদ বা বক্তব্য ধোপে টিকতো না, কিন্তু যেহেতু তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি তাই বিএনপির প্রতিবাদের ভিত্তি জোরালো হয়েছে, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকারের উঁচু পর্যায়েও যে চিলে কান নিয়ে যাওয়া নিয়ে নিজের কান না দেখে চিলের পেছনে দৌড় দেওয়ার মানুষ রয়েছে, তেমন কম বুদ্ধিমান মানুষও যে উঁচু মহলে রয়েছেÑ এমনটিই অনেকটাই বুঝতে দেওয়া হলো। তবে মূল ঘটনা সেটি, নাকি এর পেছনে সরকারের উপর মহলেই কেউ কেউ রয়েছেন যারা বিএনপিকে জাগিয়ে তোলার কোনো গোপন এজেন্ডা হাতে নিয়েছেন তা আমাদের মতো পাবলিকের পক্ষে বোঝা কিছুটা কষ্টকর। হতে পারে আমাদের বুদ্ধিসুদ্ধি ততটা বেশি নয়। সরকারের উপরের লোকদের বুদ্ধি অবশ্যই আমাদের চাইতে অনেক বেশি। তবে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে এমন কী রয়েছে যা নিশ্চিত হতে সরকারের এসব বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা গোয়েন্দাবাহিনীর সাহায্য নেন নি, তাদের পক্ষে সেটি কোনো সমস্যাই ছিলনা। এমনটিই তো হওয়ার কথা! পুলিশ দেড় ঘণ্টা তল্লাশি শেষে ফিরে গেল, কিছুই পাওয়া যায় নিÑ এমন বক্তব্যের পর বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে, তারা তা-ই করেছে। দেশের মানুষ এসব ঘটনা সম্পর্কে কে কি ভাবল তা তাৎক্ষণিকভাবে জরিপ চালিয়ে জানা না গেলেও বোঝা গেল যে, সরকারের ভেতরেও অন্য কোনো সরকার আছে! সেই সরকার কোন সরকারÑ সেটিই আসল প্রশ্ন? যে সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রায় ঘরে বসে আছে, মাঠে নেই, হতাশা, দ্বিধা-দ্বন্দ¦ নিয়ে অনেকটাই চুপচাপ বসে আছে, সেই সময়ই তাদের দলীয় প্রধানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিনা কারণে তল্লাশির খবর তাদেরকে একত্রিত হতে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ সমাবেশের ব্যবস্থা করা গেছে- তেমন সেই ধারণাই অভিজ্ঞ মহলকে দিচ্ছে।
বিএনপির জন্য বিষিয়টি কিছুটা ক্ষোভের হলেও রাজনৈতিকভাবে ভালোই হয়েছে। সরকারের জন্য অবশ্য কী বয়ে নিয়ে এসেছে তা উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশদাতারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে রাজনৈতিক অংক মোটেও সহজ নয়, বেশ জটিল, অনেক হিসাবই উল্টে যায়, অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটতে সাহায্য করে। তবে সরকারের ভেতরে তো আসল-নকল মিলিয়ে আরও অনেক সরকারই থাকে, আসলদের উচিত এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যারা ঘটায় তাদের রশি টেনে ধরা, এমন ঘটনার জন্মদাতাদের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা, জনমতকে বুঝতে চেষ্টা করা, নতুবা কখন কী ঘটে যাবেÑ তা বোঝার সময়ও পাওয়া যাবে না। মনে হচ্ছে বিএনপির প্রতি জনসহানুভূতি বৃদ্ধির প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে কেউ না কেউ সরকারের ভেতরেই কাজ করে থাকতে পারে। সম্মুখে জাতীয় নির্বাচন। তাই অনেক কিছুরই রহস্য বোঝা সহজ নয়, কিন্তু এটি কোনো শুভলক্ষণ নয়। বরং ভয়েরই কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন হয়তো কারও পক্ষে কিছুই করার থাকবে না।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়