সাধনকার্যে আহারের গুরুত্ব
পার্থ প্রতিম মজুমদার
খাদ্যের প্রশ্ন একটি গুরুতর বিষয়। হিন্দুদের মধ্যে খাদ্য- নির্বাচন নানা বিধিনিষেধ দ্বারা রক্ষিত। সবরকম আহার, যেখানে সেখানে খাওয়া, যখন তখন খাওয়া চলবে না। এসব বাধার পেছনে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিচার রয়েছে। আবার অনেক নিয়ম আছে, যা যুক্তিহীন ও অপ্রয়োজনীয়। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে অধিকাংশের উৎপত্তি সেকেলে প্রথা থেকে, যা আজকাল আর চলে না, কার্যকরিও নয়। আর যেটা চলছে তা লোকাচার মাত্র। খাদ্য বিষয়ে বিধিনিষেধের একটি সমাজতাত্ত্বিক দিকও আছে। যদিও আহার হচ্ছে একটি সাধারণ ব্যাপার, মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতির উপর এর প্রভাব রয়েছে। আমাদের বেশির ভাগের দৃষ্টি হচ্ছে দেহকেন্দ্রিক। শরীরের সঙ্গে আমরা জড়িত। স্বভাবত যা দ্বারা দেহের পুষ্টি ও রক্ষা হয়, তার প্রভাব আমাদের মনের উপর পড়ে। আর আমরা যে প্রকার খাদ্য গ্রহণ করি তার দ্বারা মন প্রভাবিত হয়। কিন্তু এই সব নয়। আমাদের প্রাণ ও মনের ক্ষমতা খাদ্যে নিহিত শক্তি দ্বারা রক্ষিত হয়। খাদ্যাভাবে জীবনীশক্তি ক্ষীণ এবং মন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই আমাদের প্রাণ ও মনের সঙ্গে আহারের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ রয়েছে। বস্তুত আমাদের বর্তমান আধ্যাত্মিক অবস্থায়, উচ্চ ও নিম্ন দু-দিকেই প্রভাব সৃষ্টি করে। এটা বলা অনুচিত যে, আমাদের যাবতীয় মানসিকভাব এবং শক্তি স্থূল দেহ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে উদ্ভূত। আবার এটিও ঠিক নয় যে, সমস্ত ভাব ও অনুভূতি কেবল আমাদের গভীরতর সত্তা থেকে নির্গত। আমাদের আত্মবিকাশে উভয়ের অবদান আছে। তাই খাদ্য এবং এ জাতীয় বিষয়ের বিবেচনা অবান্তর হলেও সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া যায় না। খাদ্য এক আশ্চর্য মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধন করে, যেজন্য এটি আধ্যাত্মিক দিক হতে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। যে কোনো টেবিলে, যার তার সঙ্গে আমরা খাই না। যে কোনো ভাবেই হোক, যার সঙ্গে বসে আমরা খাই, তার সঙ্গে একটি আন্তরিক হৃদ্যতা বোধ করি। এটি যদি সত্য হয়, তবে বাছ-বিচার না করে সকলের সঙ্গে বসে খাওয়া অনুচিত। যে অতি যতœ সহকারে খাদ্য প্রস্তুত করেছে, তৎক্ষণাৎ তার প্রতি মন কোমলভাব ধারণ করে। বাহ্য প্রকাশ না দেখা গেলেও, অন্তরে কৃতজ্ঞতাবোধ ও আন্তরিক সম্বন্ধ অনুভূত হয়। কেন এমন নয়? নিঃসন্দেহে খাদ্যের প্রভাব, শরীর ও মনের পারে, গভীরতর স্তরে প্রবেশ করে। তাই হিন্দুদের মধ্যে নিরামিষ ভোজন এত প্রচলিত।
হিন্দুদের একটি বৃহদংশ মাছ, মাংস খান না, নিরামিষাহার অহিংসার আদর্শের উপযোগী, অতএব নীতিসম্মত। আমিষাহার মানেই প্রাণনাশ। আরও কথা, নিরামিষাহার আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে আমিষাহারের চেয়ে অধিকতর সহায়ক। অবশ্য প্রাগ্?বুদ্ধযুগে নিরামিষাহার-প্রচলনের নজির পাওয়া যায় না।