সুবোধ তুই থাম, ফিরে আয়, ঘুরে দাঁড়া!
মাহফুজ জুয়েল
বেশ কমাস ধরে রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে কে যেন আপন খেয়ালে কিছু ছবি এঁকে যায় আর কিছু কথা লিখে যায়! ছবিতে দেখা যায় উস্কোখুস্কো চুল-দাড়ির এক পলায়নরত যুবক। ওর হাতে খাঁচাবন্দি সূর্য। পাশেই কথায় লেখা থাকে: সুবোধ তুই পালিয়ে যা! এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা! তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ কিংবা ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে!’ আর থাকে ইংরেজি হরফে লেখা ‘হবে কি?’
দেয়ালের এই লিখন-আঁকন ‘পড়তে পারা’ নগরবাসীর নজর কেড়েছে। ফেসবুকেও মোটামুটি ভাইরাল হয়েছে। পত্রপত্রিকাগুলোও একটু-আধটু করে ফিচার করেছে এবং করছে। কৌতূহলী নাগরিক মন জানতে চাচ্ছে, কে এই সুবোধ? কেন তাকে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে? কোথা থেকে পালাবে সুবোধ? এই শহর থেকে? সময় থেকে? সভ্যতা থেকে? নাকি পৃথিবী নামের এই গ্রহ থেকে? কেন পালাবে সুবোধ? কে বা কারা সুবোধকে পালানোর প্ররোচনা বা উস্কানি দিচ্ছে? এ রকম নানারকম প্রশ্ন উঠছে-নামছে। আগারগাঁও এলাকায় ফুলের গাছ কিনতে গিয়ে একটি দেয়ালে সুবোধকে আমিও দেখে এসেছি। আমার ভালো লেগেছে চরিত্রটির নাম। সুবোধ! সু+বোধ! হ্যাঁ, এই দুঃসহ দুঃসময়ে অবোধ নির্বোধ কুবোধের ব্যাধিকালে নামটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি শব্দটিই আসলে ‘বোধ!’
অভিধান ঘেঁটে বোধের অর্থ যা পাওয়া যায় তা হচ্ছেÑ উপলব্ধি, অনুভব শক্তি, টের, জ্ঞান, বুদ্ধি, সান্ত¡না, প্রবোধ, অনুমান; জাগরণ; চেতনা। আমরা এখনো কথায় কথায় ‘বোধ হয়’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করি। এছাড়া এক সময় ‘বোধগম্য নয়’-এরও ব্যাপক ব্যাবহার করেছে বাঙালি। বোধ বিষয়ে বোধোদয় (জ্ঞানের বা বুদ্ধির উদয় বা উন্মেষ) হলেই বোধ হয় যে, বোধ থেকেই ‘বোধি’; খুবই রাশভারি শব্দ। যার ইংরেজি মানে ইনটুইশন; আন্ডারস্ট্যান্ডিং; ইনটেলেক্ট; আর বাংলায় পরম জ্ঞান। এছাড়া যে অশ্বত্থতরুর মূলে শাক্যসিংহ বুদ্ধত্বলাভ করেছিলেন তার নাম বোধিদ্রুম বা বোধিবৃক্ষ! আর আক্ষরিক অর্থে ‘বুদ্ধ’ বলতে একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত, উদ্বোধিত, জ্ঞানী, জাগরিত মানুষকে বোঝায়। সেই অর্থে যেকোনো মানুষই বোধিপ্রাপ্ত, উদ্বোধিত এবং জাগরিত হতে পারে। সিদ্ধার্থ গৌতম এইকালের এমনই একজন ‘বুদ্ধ’। বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ববর্তী (জাতকে উল্লেখিত) জীবনসমূহকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্ব জন্মের সর্বশেষ জন্ম হলো বুদ্ধত্ব লাভের জন্য জন্ম। ত্রিপিটকে, বোধিসত্ত্ব হিসেবে ৫৪৭ (মতান্তরে ৫৫০) বার বিভিন্ন কূলে (বংশে) জন্ম নেওয়ার ইতিহাস উল্লেখ আছে যদিও সুমেধ তাপস হতে শুরু করে সিদ্ধার্থ পর্যন্ত অসংখ্যবার তিনি বোধিসত্ত্ব হিসেবে জন্ম নিয়েছেন। তিনি তার আগের জন্মগুলোতে প্রচুর পুণ্যের কাজ বা পারমী সঞ্চয় করেছিলেন বিধায় সর্বশেষ সিদ্ধার্থ জন্মে বুদ্ধ হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের ফলে তিনি এই দুঃখময় সংসারে আর জন্ম নেবেন না, এটাই ছিল তার শেষ জন্ম। পরবর্তী মৈত্রেয় বুদ্ধ জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে তার শাসন চলবে! এদিকে ‘বোধ বিজ্ঞান’ বলে বিজ্ঞানের একটি শাখা আছে। ইংরেজি ভাষায় যাকে কগনিটিভ সায়েন্স বলে। বোধ বিজ্ঞান হচ্ছে মন, মস্তিষ্ক ও বুদ্ধি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা। এই গবেষণা ক্ষেত্রের সঙ্গে অনেকগুলো জ্ঞানের শাখা যেমনÑ মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, দর্শন, কম্পিউটার বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান, ইত্যাদি জড়িত।
যা-ই হোক, সুবোধের কথায় ফিরে যাই। আমরা সুবোধকে পালাতে দিতে পারি না। আমরা বরং প্রেমার্ত আত্মার আর্তিতে চিৎকার করে বলতে চাই, সুবোধ তুই থাম, ফিরে আয়, ঘুরে দাঁড়া!/ পালাবি কেন? মুখোমুখি হ! দে গা ঝাড়া!/নে শক্তি সাহস! যা বুক ফুলিয়ে পা বাড়া!/যা অবোধ কুবোধের নাড়ি ধরে দে নাড়া! যা এগিয়ে যা! সব অশুভ বোধকে তাড়া!/আমরা কীভাবে বাঁচব বল, তোকে ছাড়া?
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান