রাষ্ট্র যখন অপরাধী
মঞ্জুরুল আলম পান্না
গত বছর হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর থেকে জঙ্গিবিরোধী বেশ কয়েকটি অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। জীবনকে বাজি রেখে তারা এসব অভিযানে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান চরিত্রহীন সমাজে যা ঘটছে, তাতে অনেক সময় সংশয়ে থাকি, আতঙ্কিত হয়ে উঠি। কেউ সরকারের গঠনমূক সমালোচনা করলেও দালাল-দলকানা আর হাইব্রিড গোছের উচ্ছিষ্ট ভোগ ইচ্ছুক নেতাকর্মীরা তার গায়ে কদিন আগেও জামায়াত সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিত, এখন বানিয়ে ফেলছে সরাসরি জঙ্গি। কোনো কোনো গণমাধ্যমের কথাও বা বাদ রাখি কী করে? তুচ্ছ ঘটনায় কদিন আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি মিডিয়া গ্রুপের জঙ্গি বানিয়ে দেবার অপচেষ্টার কথা এখনো নিশ্চয় ভুলে যাননি কেউ। আর চাঁদার দাবি কিংবা ভিন্ন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে কোনো কোনো পুলিশ বা র্যাব সদস্যের একই অপচেষ্টার অনেক কথাই তো শোনা যায়। নরসিংদীর ঘটনাটাও কেমন কেমন যেন একটু লাগছে অনেকের কাছে।
একবার ভেবে দেখুন, সত্যি সত্যিই যদি ওই মিডিয়া গ্রুপের অভিপ্রায়টির সফল হতো- কী হতো তবে অতগুলো ছাত্র আর তাদের পরিবারগুলোর অবস্থা! নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় পুলিশের আন্তরিক মধ্যস্থতায় বিশ্ববিদ্যালয়টির নিরাপরাধ ছাত্ররা সমাজের কাছে জঙ্গি হিসেবে প্রতিষ্ঠার হাত থেকে বেঁচে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের কাজে গর্বে আমাদের বুকটা ফুলে ছত্রিশ ইঞ্চি হয়ে ওঠে।
গত শনিবার নরসিংদীর উত্তর গাবতলীর বাড়িটিতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে যে ২২ ঘণ্টার অভিযান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, সেটিতে অনেকের সন্দেহ তৈরি হয়েছে। হওয়ার কিছু কিছু কারণও রয়েছে। এর আগে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানগুলোতে সাধারণ কিছু মিল ছিল। যেমনÑ ওইসব আস্তানায় মানুষের যাতায়াত নিষিদ্ধ থাকা, দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি, অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার এবং আটককৃতরা সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। কিন্তু নরসিংদীর ওই বাড়িটি থেকে আটককৃতদের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছুই ঘটেনি বলে গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে। সব অভিযানই মূলত গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। সব সংবাদ যে সঠিক হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যদি এমন হয় নরসিংদীর ওই গোপন সংবাদটি ভুল ছিল, আর সেজন্য ২২ ঘণ্টার অভিযানটিকে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটককৃতদের নামে মামলা দেওয়ার পর তাদের কারাগারে পাঠানোর মধ্যদিয়ে প্রশাসন তার নিজের ব্যর্থতা এড়াতে চাচ্ছে, তবে সেটি হবে অনেক বড় ধরনের ভুল, অনেক বড় অন্যায়। র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির কিশোর লিমনকে সন্ত্রাসী বানানোর অপচেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে পুলিশের নেশাখোর বানানোর কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের ছাত্র আব্দুল কাদেরকে ছিনতাইকারী বানানোর মতো অনেক ঘটনাই তো আমাদের জানা আছে। ভয় আর সন্দেহের দানাগুলো বাঁধে অতীতের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে।
বিশেষ কারোর উৎসাহে রাজনৈতিক উস্কানি দিতে অথবা ভুল কোনো গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাড়িতে তল্লাশি অভিযানে কিছু না পাওয়া যাওয়ার মতো ঘটনায় সরকারের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি যে কমেছে তা ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিছুদিন আগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে খুলনার বিএল কলেজে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিক্ষোভ মিছিল করলে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা শেষে দুজনকে ধরে জঙ্গি অপবাদ দিয়ে কলেজ প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়। কলেজটির প্রাধ্যক্ষ তাদেরকে তুলে দেন স্থানীয় দৌলতপুর থানা পুলিশের কাছে। পরে সেখান থেকে নিরাপরাধ ওই ছাত্রদেরকে মুচলেকা দিয়ে অনেক ছাড়িয়ে আনেন বাম দলগুলোর ঊর্ধ্বতন নেতারা। এ খবরটি হয়তো অনেকেই জানেন না। সব খবর গণমাধ্যমে আসেও না। না জানি এমন করে কত অসংখ্য নিরীহ মানুষকে জঙ্গি অপবাদ দিয়ে মামলা মোকদ্দমার মাধ্যমে তাদের জীবনকে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে!
দায়িত্বশীল সকলের প্রতি আবেদন, পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অস্থির সমাজে কোনো নিরীহ মানুষকে যেন জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বানানো না হয়। এতে প্রকৃত জঙ্গিরা উৎসাহিত হবে। এতে করে জঙ্গির সংখ্যা বাড়বে ছাড়া কমবে না নিশ্চয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান