দেশীয় পোশাক, আগামীর বিকাশ
ফাহমিদা হক
ঈদ সমাগত। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে নতুন পোশাক। প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। আর এর একটা অন্যতম অংশজুড়ে থাকে পোশাক বাণিজ্য। মানুষের মৌলিক চাহিদার দ্বিতীয় স্থানে থাকা পোশাক, একসময় নিতান্তই চাহিদা পূরণে ব্যবহার হলেও এখন পোশাক মানে ফ্যাশনের অন্যতম অংশ। দেশীয় সমৃদ্ধশালী কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে দেশীয় কাপড়, দেশীয় বুননে রং ও নকশার বৈচিত্র্যে এসব পোশাকই বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণের উৎসবকে করে তুলে আরও রঙিন। কারণ এইসব পোশাকের ডিজাইনে রয়েছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির অপূর্ব সব ছোঁয়া। সমাজের সৌখিন ও ফ্যাশন সচেতন লোকদের কেনাকাটার জায়গা হিসাবে পরিচিত দোকানই হচ্ছে বুটিক হাউজ। বুটিক ফরাসি শব্দ হলেও এর সযতœ ব্যবহার আর নান্দনিকতায় তা এখন আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। বুটিকের পণ্য তৈরিতে যে সমস্ত সামগ্রী ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছেÑ ব্লক, বাটিক, এমব্রয়ডারি, কারচুপি এবং হ্যান্ডিক্রাফট।
বাংলাদেশে দুই যুগের ব্যবধানে বুটিকের সঙ্গে জড়িত নারীদের একটি প্লাটফর্ম হয়েছে। বর্তমানে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ১৩০টি রেজিস্টার্ড বুটিক হাউজ রয়েছে। এর বাইরেও সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে আরও প্রায় ৫ হাজার বুটিক হাউজ। এ শিল্পের নিজস্ব বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এর বাজার চাহিদা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। বুটিক শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের প্রায় ১০০ ভাগ নারী। বুটিক হচ্ছে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং চামড়া শিল্পের সহায়কশিল্প। এই শিল্পের উন্নতি হলে আলাদা রুচি ও বৈশিষ্ট্যের বাজার সৃষ্টি হবে। বুটিকের তৈরি পোশাকের দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগও রয়েছে। বিশেষ করে ইউএসএ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ এবং ইউকে সবচেয়ে বড় বাজার হতে পারে আমাদের জন্য। কারণ সেখানে প্রচুর বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাই রপ্তানির মাধ্যমে এ শিল্পকে আরও লাভজনক করার সুযোগ রয়েছে।
এক সময়ের ঘরোয়া বা সৌখিন বুটিক হাউজগুলোই এখন বাজার বিকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, নান্দনিকতায় এবং দেশীয় ভাবধারার এসব পোশাক বর্তমানে সব বয়সের মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। কিছু উদ্যমী এবং স্বাপ্নিক তরুণের স্বপ্নই দেশে তৈরি করা কাপড় দিয়ে ফ্যাশনেবল পোশাক তৈরি ও তা জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তার প্রমাণ, একসময় পাশ্চাত্য ফ্যাশনের উপর অনুরক্তদের একটি বড় অংশই এখন দেশীয় পোশাকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। ফ্যাশন হাউজগুলো তাদের নিজস্বতা তথা শিল্পের স্বাক্ষর রেখে ফ্যাশনের উজ্জ্বল দিগন্তকে আরও দ্যুতিময় করে তুলেছে তাদের নানান সুচারু কর্মদ্বারা। আড়ং, অঞ্জন’স, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রঙের মতো ফ্যাশন হাউজগুলো দেশীয় সকল শ্রেণির ক্রেতাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিদেশেও কিছু পরিমাণে রপ্তানি করছে।
ফ্যাশন হাউজগুলো এদেশের মানুষের মধ্যে কেনাকাটায় এই সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আগে যেখানে মানুষ শুধু ঈদ বা পূজার সময় নতুন পোশাক কেনার চিন্তা করত এখন সব উৎসবে মানুষ নতুন পোশাকে নানান সংস্কৃতির রুচিশীলতায় যুক্ত থাকতে পারছে স্বাচ্ছন্দ্যে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সকল সেরা ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক নির্মাণ করে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সেই বাংলাদেশেরই কিছু সংখ্যক উদ্যোক্তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় সৃষ্ট দেশীয় পোশাকের এই বুটিক শিল্প যখন নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষমতা অর্জন করছে এবং দিন দিন তা বিস্তার লাভ করছে। সেক্ষেত্রে এই শিল্পকে ছোট করে দেখা, অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, ব্যাংক ঋণ, বৈদেশিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মর্যাদা ও সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে এই শিল্পও দেশ সমৃদ্ধির সহায়ক শক্তি হয়ে কাজ করতে পারে।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: আশিক রহমান