বাজেটের পর আমাদের জীবন কেমন চলবে?
মিল্টন বিশ্বাস
জুনের পহেলা তারিখে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত বর্তমান সরকারের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। সংবাদপত্র সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ ভ্যাট ১৫% হওয়ায় অনেক পণ্য কিনতে মানুষকে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। যদিও বেড়েছে অব্যাহতির সীমা। তবু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন সব ধরনের আয় ও মুনাফার ওপর কর এবং শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার উল্লম্ফন ঘটানো হয়েছে। যদিও বাজেটে বলা হয়েছে, বিপুল খরচের বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং সরকারি বিনিয়োগে ভর করে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে। কিন্তু যে প্রশ্নটা আসছে বারবার, প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা দুর্নীতির অবসান করা সরকারের পক্ষে এখনো সম্ভব হবে কী? অথচ নিম্ন আয়ের মানুষদের সরকারের উচ্চাভিলাষী রাজস্ব স্বপ্নের মাসুল গুনতে হবে। অবশ্য বাজেটে শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার রক্ষা করা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থ বরাদ্দে অর্থপূর্ণ প্রবৃদ্ধি রেখে।
বাজেটের মোট ব্যয়ের মধ্যে বড় দুই খাত উন্নয়ন ব্যয় এবং অনুন্নয়ন ব্যয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপিসহ উন্নয়ন ব্যয় আগেই চূড়ান্ত হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়েই তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণও হয় এই উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ থেকে। বরাবরের মতো এবার সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। রাস্তা-ঘাট, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের বাইরে সরকার যে ব্যয় করে তাই অনুন্নয়ন ব্যয়। এর বড় অংশ চলে যায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন পরিশোধ এবং দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে, ভর্তুকি ও প্রণোদনা ব্যয় মেটাতে।
কিন্তু বর্তমান বাজেটের প্রধান একটি টার্গেট হলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে দিক-নির্দেশনা। কিন্তু সবচেয়ে বড় বরাদ্দ বরাবরের মতো শিক্ষা খাত পেলেও স্বাস্থ্য খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কম বরাদ্দ পেয়েছে। অগ্রাধিকারমূলক বড় প্রকল্পগুলোতে অর্থ বরাদ্দ অব্যাহত থাকলেও পদ্মা সেতু ছাড়া অন্যগুলোর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলে মনে করছেন অনেকেই। অন্যদিকে ধূমপায়ীদের অত্যাচার থেকে আমরা বাঁচতে চাইলেও তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ বাজেটে নেই। নাগরিক জীবনে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা করার কোনো প্রচেষ্টাও অনুপস্থিত। অন্যদিকে নিরন্তর ভোগান্তির ঢাকা শহরের যানজট থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে অবকাঠামো তথা রাস্তা কিংবা ফ্লাইওভার তৈরির ঘোষণা নেই বাজেটে। আর বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের আয়কর প্রদানের সহজ নিয়মের কোনো চিন্তাও নেই। বরং মধ্যবিত্তের ওপর সবকিছুর চাপ বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে বাজেট দেখে। তবু জাতীয় নির্বাচনের দেড় বছর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দক্ষতা অর্জনের দৃষ্টান্ত। এই সরকার সক্ষম বলেই বড় অঙ্কের টাকার বাজেট দেখার সুযোগ আমাদের জীবনে ঘটেছে।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান