হ্যালো অর্থমন্ত্রী, আমি এক গাঁধা বলছি…!
দেশের যে অর্থমন্ত্রীর কাছে চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই নয়, তার কাছে এক লাখ টাকা এত বেশি মনে হওয়ার কারণ কী? কারণটা এদেশের আপামর গণমানুষ বেশ ভালোই বোঝে। চোর-ডাকাতরা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেপুটে নেবে। রাষ্ট্রীয় আশীর্বাদে থাকা জাতীয় ছিনতাইকারীদের কিছুই করতে পারবেন না। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে মানুষকে বুঝ দেবেন, চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না। আবার সরকারের আয়ের পথ খুঁজতে ছুরি বসানো হবে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন খাতে। বলছেন, যাদের এক লাখ টাকা আছে তারা যথেষ্ট সম্পদশালী। অর্থনীতিতে সমতা আনতেই ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার ওপর আবগারী শুল্ক বাড়ানো হয়েছে বলে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আপনি মন্তব্য করেছেন। গরিবকে আরও গরিব করার অর্থ বুঝি অর্থনীতির সমতা?
এক থেকে দশ লাখ টাকায় পাঁচশ থেকে আটশ টাকা করেছেন আবগারী শুল্ক। এই তিনশ টাকা আমাদের মতো ছাপোষাদের কাছে অনেক। দশ লাখ টাকার ওপরে এক কোটি টাকা পর্যন্ত তা বাড়ালেন আবার মাত্র এক হাজার টাকা। এভাবে ধাপে ধাপে বাড়ানো হলো। বাড়ান, সমস্যা নেই। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর কেন? তাছাড়া ব্যাংক আমানতের ওপর সরাসরি কর ধরা হয় পৃথিবীর কোন দেশে? এমনিতেই মুড়ি-মুরকীর মতো যাকে তাকে ব্যাংক লাইসেন্স দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরের বারোটা বাজিয়েছেন। আমানতকারী সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আপনার নতুন সিদ্ধান্তের পর ব্যাংকগুলো যে ব্যাপক পুষ্টিহীনতায় ভুগবে এবার।
আপনার সতীর্থ মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী বলে ফেললেন, ‘বিদেশে টাকা পাচার ঠেকাতে ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারী শুল্ক বাড়ানো হয়েছে’। এসব কী ধরনের যুক্তি? বিদেশে টাকা পাচার করছে কারা? এক-দুই-পাঁচ লাখ টাকার মালিকেরা? বিদেশে যারা টাকা পাচার করছেন তাদের ধরার জন্য তো কিছু করা হচ্ছে না, পাচার রোধে নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর কোনো কৌশল। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, কেবল ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৪ সালে যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে, তা চলতি অর্থবছরের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার সমান। তাদের কিছু না করে শুল্কের নামে কথিত নতুন নতুন আইনের ফাঁকে চোখের সামনে আমাদের ঘামে ভেজা টাকা জোর করে কেড়ে নিচ্ছেন বাজেট নামের পাগলা ঘোড়ার রসদ যোগাতে, সে আমরা ভালোই বুঝি। দুর্নীতিবাজদের কারণে হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যায় নিঃস্ব হলো লাখ লাখ কৃষক। ভেসে গেল সোনার ধান। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলোÑ হাওরের ফসলহানি অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সরকারের অন্যতম শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে নিজেই স্বীকার করে নিলেন, ‘হাওর এলাকায় দুর্যোগের প্রভাবে চালের দাম বেড়েছে’। এভাবে যখন যা খুশি আপনারা বলছেন, করছেন। আপনার ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও বললেন, ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ভ্যাট বাড়লে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য হবে না।’ এটা আবার কী ধরনের কথা? সেই পুরানো কথা-ই আবার টানতে হচ্ছেÑ শিক্ষা কী সরাসরি পণ্য হয়ে গেল? পণ্য কিনলে তো ভোক্তাকে ভ্যাট দিতে হয়। তাহলে এক শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ভ্যাট দিতে হবে আর অন্য কাউকে দিতে হবে না, এটা বৈষম্য নয়তো কী? আর ইংলিশ মিডিয়ামের ক্ষেত্রে শিক্ষা যদি পণ্য হয়েই থাকে সেক্ষেত্রে জমজমাট ব্যবসা তো করছে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ। তাহলে ভ্যাটের নামে চাঁদা দেবে কে?
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনার কী মনে হয় আমরা সব গাঁধা? আসলে আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমরা সবাই নির্ভেজাল গাঁধা। এতদিন জেনে এসেছি গাঁজা, আফিম বা দেশীয় মদ বিক্রির ওপর যে শুল্ক আরোপ করা হয় কিংবা দেশে উৎপাদিত নির্দিষ্ট কিছু পণ্য, যেমন তামাক, অ্যালকোহল এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানি তেলের ওপর যে শুল্ক আরোপ করা হয় তা-ই আবগারী শুল্ক। এখন আপনি আমাদের সামনে আদর্শ লিপির মতো নতুন নতুন বই মেলে ধরছেন তা মুখস্থ করে গেলানোর জন্য। ডিজিটাল যুগে এসে ব্যাংকে লাখ টাকা জমা রাখলেই আবগারী শুল্ক, শিক্ষার্থীকে দিতে হবে ভ্যাট! চরম সৌভাগ্য আপনার। এমন শান্ত-শিষ্ট-লেজ বিশিষ্ট কয়েক কোটি গাঁধাকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছেন আপনি। ভেবে দেখুন তো এরা যদি সবাই মানুষ হতো, কী হতো তবে?
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান