এই পোড়া দেশে সবাই যে নিপীড়িত!
মাহফুজ জুয়েল
প্রবাদ-প্রবচনগুলোই প্রকৃত গণকবিতা; মা-মাটি-সময়-শেকড়ের অন্তরের অন্দরের ছাপচিত্র। যা খুবই সংহত ও শক্তিশালী। ওগুলো এককথায় অনেক কথা বলে। যেমন ‘বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট!’ এই প্রবচনটি হয়তো কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট, কিন্তু সৃষ্টির কী অনাসৃষ্টি, এখন তা একটা আস্ত জাতির জন্যও খাপেখাপ খাটে! বাঙালি জাতি এবং তার রক্তার্জিত স্বাধীন রাষ্ট্র, দুটোই আজ ওই প্রবচনের হাত ধরে নেচে-গেয়ে হাঁটে। হ্যাঁ, উন্নয়নের আকাশচুম্বী হট্টগোলের মধ্যে, ওই ফিটফাটের মধ্যেও দিব্যি দেখা যাচ্ছে, বাঙালির বাংলাদেশের প্যান্টের জিপার খোলা! ওর ভেতরটা ঘিনঘিনে সদরঘাট!
আজকাল কোনোকিছু লিখতে গেলেই এ রকম প্রবাদ প্রবচন মাথায় ঘোরে। ওই যে, সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা? আর ব্যথারও তো রকম-সকম আছে! চিমটি কাটা আর থাপ্পরের ব্যথা তো এক নয়। আলপিন বা সুঁই ফোটার ব্যথা আর চাপাতি-রামদা, কুড়াল-কোদালের উপর্যুপরি কোপের ব্যথা তো এক নয়! এত এত দুঃসহ ব্যথা জমেছে আমাদের! এমন প্রগাঢ় গাঢ় অমাবস্যার অমোঘ অন্ধকার। এ এক আপাদমস্তক নৈরাজ্যের রাজ্য, সত্যিকারের মগের মুল্লুক। এখানে এখন মানুষ দুর্লভ, সুলভ শুধু উল্লুক-ভাল্লুক। না না, বাজে কথা বললাম। উল্লুক-ভাল্লুক এতটা ঊনমানুষ নয়, না-মানুষ নয়, অ-মানুষ নয়। এতটা নিবেদিতপ্রাণ আত্মঘাতী জাতি, এতটা নৃশংস নির্বোধ আর কেউ হতে পারে না। হওয়া অসম্ভব।
আমার বুকে এখনো রাঙামাটির লংগদুর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই আগুনেই আমি পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছি। অথচ এই আগুন অনেক পুরনো আগুন। বছরের পর বছর ধরেই সেই আগুন জ্বলছে। এই আগুন সুপরিকল্পিত আগুন। সুকৌশলী আগুন। স্বয়ং রাষ্ট্রের ঠা-া মাথায় লাগানো রাজনীতির আগুন। যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বেড়েই চলছে দ্বিগুণ ত্রিগুণ।
সম্প্রতি এক সেটেলার বাঙালির (মোটরসাইকেল চালক) লাশ উদ্ধারের জের ধরে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলায় পাহাড়ি আদিবাসীদের গ্রামে আবারও আগুন লাগানো হয়েছে। ওই বাঙালিকে পাহাড়ি আদিবাসীরা হত্যা করেছে এমন অভিযোগে স্থানীয় সেটেলাররা ২ জুন শুক্রবার সকালে স্থানীয় একটি মসজিদে মাইকিং করে সবাইকে জড়ো করে। সেখান থেকে লাশ নিয়ে মিছিল শুরু হয়। তারপর বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা উপজেলা সদরের আদিবাসী মালিকানার দোকানগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। পরে উত্তেজিত সেটেলাররা দলবদ্ধভাবে আদিবাসী গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। ঘরবাড়ি লুটপাট করে, লুটপাট শেষে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এটা ২০১৭ সালের ঘটনা। কিন্তু আজ থেকে ২৮ বছর আগে, ৪ মে ১৯৮৯। বিকেল ৪-৫টার দিকে, সংঘটিত হয় ন্যক্কারজনক লংগদু গণহত্যা! তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার নিজ অফিসে অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন। এ হত্যার জের ধরে আনসার, ভিডিপি সদস্যরা সেটেলার বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে লংগদুর প্রায় ছয়টি আদিবাসী গ্রামে আগুন লাগিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী, হত্যাকা-ে শিশুসহ ৩৬ জন নারী-পুরুষ নিহত হয়। নিখোঁজ হয় আরও অনেকে। ধ্বংস হয় দুটি গির্জাসহ অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির। ভস্ম হয় বুদ্ধ অগনিত বুদ্ধমূর্তি।
ওই ঘৃণিত গণহত্যার ২৮ বছর পরও হত্যাকা-ে জড়িতদের কারও বিচার হয়নি। একটি শ্বেতপত্রও প্রকাশ করেনি রাষ্ট্র। ওই হত্যাযজ্ঞের আগেও আরও অনেক গণহত্যা হয়েছে পাহাড়ে। গোমতি গণহত্যা, লোগাং গণহত্যা, কমলপতি গণহত্যা, নানিয়ারচর গণহত্যাÑ এ রকম কমপক্ষে ২৫টি গণহত্যার হাহাকার নিয়ে বেঁচে আছেন আদিবাসীরা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে হারানো আদিবাসী নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার মতো দুয়েকটি নাম হয়তো আমরা জানি, কিন্তু এ রকম কত কত কল্প আর কল্পনা যে প্রতিদিন খুন হয়, গুম হয়, ধর্ষণের শিকার হয়, পুড়ে ছাই হয়, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এ কারণেই এক আদিবাসী বন্ধুকে আর্তনাদ করে বলতে শুনি, দু-একটি স্বাধীন দেশে পরাধীনতার খাঁচায় ভরা রাষ্ট্রীয় শোষণে ইচ্ছে মতোন অত্যাচারিত একটি জাতি কোথায় নিপাতিত হবে অদূর ভবিষ্যতে? নিশ্চিহ্ন করার ছকে বাঁধা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়া একটি জাতি কার কাছে গিয়ে মিনতি জানাবে? এই পোড়া দেশে সবাই যে নিপীড়িত!’
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান