নোবেলটি আমাদের হলো না!
প্রতীক ইজাজ
আবারও আলোচনায় ড. মুহাম্মদ ইউনুস। আবারও সেই নেতিবাচক প্রসঙ্গ। বিতর্কে, সমালোচনায়। ২০১১ সাল থেকে এই নোবেলজয়ীর নানাবিধ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। আর সেটি ঠেকাতে তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ড. ইউনুসের বন্ধু হিলারি ক্লিনটন প্রভাব খাটিয়েছেন কি না, এবার তার তদন্ত শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে দেশের ভেতর শুরু হয়েছে আরেকদফা আলোচনা। চলছে মুখরোচক গল্প। ঘুরে-ফিরে আসছে বিতর্কিত এই নোবেলজয়ীর নানা কীর্তিকলাপ। রাষ্ট্রবিরোধিতা, নেতিবাচক রাজনীতি, স্বজাত্যবোধহীন সংস্কৃতি। অবশ্য তার পক্ষেও গোষ্ঠী আছে, রাজনৈতিক দল আছে। তার পক্ষেও কথা বলার লোক আছে। সে থাকতেই পারে। কিন্তু আমার ভাবনাটা অন্য জায়গায়, অন্য প্রসঙ্গে। ভাবি, এমন জনসংস্রব ও দেশজ সংস্কৃতিবিমুখ, এমন জনবিরোধী মানুষ কি করে এমন নোবেল পায়! দক্ষিণ আমেরিকার এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী নোবেলজয়ীর কথা জানি আমি। যতবার তাকে পড়ি, ছবি দেখি, তামাটে মুখখানা চোখে ভাসে, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। সেখানকার পিছিয়ে পড়া, নির্যাতিত মানুষের জন্য, তাদের ভূমির অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য, জীবনভর কী যে শ্রম, মেধা, চেষ্টা ছিল তার, ভাবলে অবাক লাগে।
আর আমাদের ড. ইউনুস! অবাক, আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ড. ইউনূস এবং তার গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পায়। নিঃসন্দেহে সেটা ছিল আমাদের জন্য, দেশের জন্য এক ‘বড়’ সম্মান। কিন্তু সে সম্মানটা উনি রাখতে পারেননি। কাজে লাগাতে পারেননি না নিজের জন্য, না রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য। বরং বারবার তারই জন্য দেশ ও দেশের মানুষকে হেয় হতে হয়েছে বিশ্বের কাছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে দুর্নাম কুড়াতে হয়েছে। লজ্জায়, অপমানে মাথা হেট হয়েছে আমাদের। এমনকি আর্থিক ভোগান্তিও কম পোহাতে হয়নি রাষ্ট্রকে। অবশ্য ড. ইউনুসের নোবেল পাওয়া নিয়ে বিতর্ক তখন থেকেই। অর্থনীতিতে না দিয়ে কেন শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলোÑ এই প্রশ্ন স্বভাবতই উঠেছিল। অবশ্য এমন প্রশ্নের অবতারণা এই প্রথম নয়। মনে করা হয় পুঁজিবাদী দুনিয়ার স্বার্থরক্ষাকারী কেউ কেউ এই নোবেল পান বিশেষ ‘ইনাম’ হিসেবে। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও খ্যাতনামা শান্তিবাদী রাজনীতিবিদ মহাত্মা গান্ধীকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে সমরবাদী মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিনজারকে, দেওয়া হয়েছে ইসরাইলের বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রীকে। তারপরও ড. ইউনূস নোবেল পেয়েছেন। সঙ্গত কারণেই আশা জেগেছিল, স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু তা পূর্ণ হয়নি। তার আচার-আচরণ, দেশপ্রেম, রাজনীতি ও সংস্কৃতিÑ অন্য নোবেল বিজয়ীদের মতো দেখা যায়নি, অদ্যাবধি না।
এই বড় পুরস্কার তাকে বিনয়ী না করে আরও অহঙ্কারী করে তুলেছে, দূরে ঢেলে দিয়েছে স্বজাত্যবোধ থেকে। দেশের মানুষ নয়, তার আশ্রয় হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতি, দূর-দূরান্তের মানুষগুলো। নোবেলের পর তার মনোযোগ গেল রাষ্ট্রের ক্ষমতায়। আর সে জন্য তিনি এমন এক রাজনীতির পথ বেছে নিলেন, যা ছিল কেবল কল্পনাপ্রসূতই নয়, অবান্তর, বোধহীন এক রাজনৈতিক দর্শন। বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত এক-এগারোর সময় যখন রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার চক্রান্ত হয়, তখন চরম সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী নীতি অনুসরণ করে সামরিক কর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত সফল হননি। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুলটি করেই ফেললেন। এমনকি এরপরও সেই ভুল সংশোধনের পথে তো হাঁটলেন-ই না, উল্টো রাষ্ট্রবিরোধী এমন সব কর্মকা-ে অদ্যাবধি তিনি লিপ্ত রয়েছেন, যা তার প্রতি মানুষের কেবল বিতৃষ্ণা ও ঘৃণাই জন্ম দিচ্ছে। তবুও ঘুরে-ফিরে সেই একই ভাবনা তাড়িত করে আমাকে: নোবেলটি আমাদের হলো না! ড. মুহাম্মদ ইউনুস আমাদের হলেন না!
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান