উচ্চ আদালতে বিচারক সংকট, নিয়োগ নেই দুই বছরেও
এস এম নূর মোহাম্মদ : সারাদেশের মতো মামলাজট বেড়ে চলেছে উচ্চ আদালতেও। যদিও প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হা সারা দেশের মামলা জট কমাতে বিশেষভাবে নির্দেশনা দেন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তবে বিচারক সংকটের কারণে মামলাজট পুরোপুরি শেষ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দ্রুত বিচারক নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও সংবিধানে উচ্চ আদালতে বিচারকের কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করা নেই। প্রধান বিচারপতির পরামর্শ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময় বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী বেশ কয়েকটি এজলাসও তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া আপিল বিভাগে এখন দুটি আদালত বসলেও আপিল বিভাগ-৩ নামে আরও একটি এজলাস তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বিচারক সংকটের কারণে ওই এজলাস অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে ৩১ লাখ ৯৮ হাজার ১৮২ টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৩ হাজার ৯২ এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ৪ লাখ ৩১ হাজার ১৯৪টি মামলা। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি রয়েছেন সাতজন আর হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছেন ৮৭জন। যদিও আপিল বিভাগে এর আগে সর্বোচ্চ ১১ জন বিচারপতি বিচারকার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এ বছর অবসরে যাচ্ছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসরে যাচ্ছেন বিচারপতি মো. মিজানুর রহমান ভূঁঞা, বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদুল হক ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী। এর আগে সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল অবসরে যান বিচারপতি শামীম হাসনাইন। ১৪ মার্চ অবসরে যান আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম। আর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ফরিদ আহাম্মদ অবসরে যান ১ ফেব্রুয়ারি।
এছাড়া আপিল বিভাগের বিচারপতি বজলুর রহমান গত ১ জানুয়ারি মারা যান। আর গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর মারা যান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জেএনদেব চৌধুরী। এর বাইরেও গত দুই বছরে অবসরে গেছেন হাইকোর্টের অন্তত দশজন বিচারপতি। এছাড়া বর্তমানে তিনজন বিচারপতি কাজ করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সরকার ১০ জনকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে দু’বছরের জন্য নিয়োগ দেয় সরকার। তাদের মধ্যে গত ডিসেম্বরে একজন মারা যান। আর একজনকে বাদ দিয়ে বাকি আটজনকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয় সরকার। বর্তমানে স্থায়ী নিয়োগ না পাওয়া দুই বিচারপতির রিট আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে আপিল বিভাগে। ২০১৫ সালের পর গত দুই বছরে উচ্চ আদালতে আর কাউকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদিও গতবছরের আগস্টে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে সেপ্টেম্বরে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে হাইকোর্টে নিয়োগের জন্য আটজনের নাম প্রস্তাব করে সুপারিশ পাঠানো হয়। জানাগেছে এ তালিকা আইন মন্ত্রণালয় হয়ে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রয়েছে। এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি সরকারকে বেশ কয়েকবার তাগাদাও দিয়েছেন। তবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এই সুপারিশ প্রেরণ করা হলেও নিয়োগ প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি এখনো।
এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট আইন কমিশন বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশমালা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। আইন কমিশন তাদের সুপারিশে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারপতি পদে নিয়োগ চেয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট। এর আগে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালের ৩০ মে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী রাগীব রউফ চৌধুরী। ওই রিটের প্রেক্ষিতে জারি রুলের চূড়ান্ত শুনানি করে গত ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। সম্প্রতি যার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বিচারক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির যোগ্যতা সম্পর্কে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এদিকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, মামলাজট দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমরা চাই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। এজন্য দ্রুতই বিচারক নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। তিনি বলেন, অনেক দিন থেকেই নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের টানাপড়েনের জন্যই হয়তো নিয়োগ দেরি হতে পারে বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, বিচার বিভাগ খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। বিচারপতি নিয়োগে আইন নেই। এখানে সংবিধান অনুযায়ী সরকার বিচারপতি নিয়োগে আইন করতে পারতো। অথচ সরকার অপসারনের জন্য সংবিধান সংশোধন করেছে। তিনি বলেন, জরুরী ভিত্তিতে দক্ষ বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। হাইকোর্ট যে নীতিমালা দিয়েছে এটা বিচার বিভাগের জন্য খুবই মঙ্গলজনক। নীতিমালা অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগে কোন অসুবিধা নেই বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন পর্যন্ত আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে কোন বিচারপতি নিয়োগ হচ্ছে না। অনেকে অবসরে গেছেন এবং আরও যাবেন। এরফলে বিচার ব্যবস্থায় একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে মামলাজট বেড়েই চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জনগণের ভোগান্তিও। কিন্তু সরকারের এ ব্যাপারে কোন দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না। যেহেতু জনগণের প্রতি এ সরকারের কোন দায় দায়িত্ব নেই। তাই সরকার দ্রুত বিদায় না নিলে বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক স ম রেজাউল করিক বলেন, দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিচারপতি নিয়োগ হওয়া দরকার। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন তৈরির কথা সংবিধানে বলা আছে। ৪৮ বছরেও কোন আইন তৈরি হয়নি। তবে আইন না হলেও এর আগে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হয়ে আসছে, সে প্রক্রিযায় নিয়োগ দিতে কোন বাধা নেই। তাই দ্রুত আরও বিচারপতি নিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, দক্ষ ও সৎ আইনজীবীদের মধ্য থেকে আরও বিচারপতি নিয়োগ হওয়া উচিৎ। এর আগে আইন হওয়া দরকার। দ্রুত নিয়োগ হলে মামলাজট কমবে বলে মনে করেন তিনি। সম্পাদনা : উম্মুল ওয়ারা সুইটি