সৌদি কাতার বিরোধÑ ইনসাইড স্টোরি
তাজউদ্দিন সবুজ
সৌদি আরব এবং আরও চারটা দেশ কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সৌদি আরবের সরকারি বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সি বলেছে, কাতারের সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের বিপদ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য রিয়াদ এ ব্যবস্থা নিয়েছে। সৌদি সরকার অভিযোগ করেছে, গত কয়েক বছর ধরে কাতার মারাত্মকভাবে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে। আসল ঘটনার জন্য আমাদের একটু পেছনে যেতে হয়।
২০০৯ সালে তুরস্কে একটা পাইপলাইন চুক্তি হয় নাবুক্কো ওয়েস্ট পাইপলাইন নামে যাতে কাতারের এবং ইরানের মাঝখানে পারস্য উপসাগরে কাতারের মালিকানায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র সাউথ পার্স ও নর্থ ডৌম থেকে গ্যাস উত্তোলন করে ইউরোপে সরবরাহ করবে। কাতার, সৌদি আরব, জর্ডান ও সিরিয়া হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত একটি নতুন পাইপলাইনের চিন্তা করে। ২০০৯ সালে কাতার ও তুরষ্কের শীর্ষ নেতৃত্ব এ-ঘোষণা দেন। ২০১০ সালে সিরিয়ার কাছে কাতারের প্রস্তাব হাজির করা হলে প্রকল্পটি সিরিয়ার মিত্রদেশ রাশিয়ার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে বলে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ প্রত্যাখ্যান করেন। বিষয়টি কাতার, তুরস্ক, জর্ডান ও সৌদি আরবসহ ইউরো-মার্কিনিদের হতাশ করে।
কিন্তু এক বছর পর একই পারস্য উপসাগরের সাউথ পার্স ও নর্থ ডৌম গ্যাসক্ষেত্রের ইরানি শরিকানাধীন অংশ থেকে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন হয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের উদ্দেশ্যে নতুন পাইপলাইন নির্মাণের জন্য সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে কাতার, তুরস্ক, জর্ডান, সৌদি আরব ও তাদের ইউরো-মার্কিন মিত্ররা সাংঘাতিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মূল ঘটনা হলো এই। এই কারণে কাতার সৌদি মার্কিনিরা সিরিয়ায় আসাদের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার আনতে চায়। যাতে কাতারের ট্রিললিয়ন ডলারের গ্যাস ইউরোপে সরবরাহ করে রাশিয়াকে চাপে রাখা যায় এবং কাতারের গ্যাসের একটা মার্কেটই তৈরি হয়। কাতার এই জন্য সিরিয়ায় সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে আইএস নুসরা ফ্রন্ট তৈরি করে। সৌদিরাও ওদের অস্ত্র সহযোগিতা দেয়।
সিরিয়ার পক্ষ হয়ে ইরান এবং রাশিয়া যুদ্ধ করে এবং বলা চলে এই মুহূর্তে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সিরিয়ার আসাদের পক্ষে। কাতার তাদের বিপুল বিনিয়োগ লসের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় গোপনে ইরানের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে কারণ কাতারি অব্যবহৃত গ্যাস ইউরোপে বিক্রি করতে হলে ইরানকে প্রয়োজন। নাবুক্কো পাইপলাইন আপাতত আর কাজ করছে না উপরন্তু আন্তর্জাতিক গ্যাসের বাজারে আমেরিকা এবং অস্টেলিয়ার আগমন ঘটেছে। সৌদিরা কাতারি পয়সা ব্যবহার করে সিরিয়ায়, ইরাক এবং ইয়েমেন যুদ্ধ করছে। কাতার তার লস করে আর যুদ্ধ করতে চায় না।
উপরন্তু কাতারি গোয়েন্দারা আমির তামিমকে একটা ইনফরমেশন দেয় যে সৌদিরা তামিমকে সরাতে চায় এবং ট্রাম্পের তাতে সায় আছে। উপসাগরীয় জোটে তামিমই একমাত্র সৌদিদের সমালোচনা করে। তামিম স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে চায়। সে গোপনে তার পরারাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইরাকে পাঠিয়ে ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাশেম সোলাইমানির সঙ্গে মিটিং করে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন এর বিষয় মিটমাট করে নেয় এবং জানিয়ে দেয় সিরিয়া এবং ইয়েমেনে সে আর হস্তক্ষেপ করবে না। তার বিনিময়ে তার গ্যাস ইরানি পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে রপ্তানি করতে চায় এবং ইরানের সহযোগিতা চায় তার সরকার রক্ষায়। ইরান তাতে সায় দেয়।
কাতারের ৯০ ভাগ খাদ্য সরবরাহ হয় সৌদি থেকে। সম্পর্ক ছিন্নের কারণে যেন কাতারে খাদ্যাভাব না হয় তার জন্য আজ বিকালে ইরান খাদ্যভর্তি জাহাজ পাঠিয়েছে কাতারে এবং তামিমকে ইরান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। পরিশেষে এতটুকু বলা যায়, ভূ-রাজনীতিতে ইরানের অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে এবং সৌদিরা অনেকটাই কোণঠাসা হয়েছে তাদের মিন পলিটিকসের কারণে।
লেখক: কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান