যে কারণে ৬ দফা আমাদের বাঁচার দাবি ছিল
ড. অনুপম সেন
প্রকৃতপক্ষে ৬ দফাই ছিল আমাদের মুক্তির সনদ। অর্থনীতির মুক্তির দলিল। ১৯৪৭ সালে যখন লাহোরের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান পরিণত হলো তখন অনেকগুলোর স্টেটের মধ্যে একটা স্টেটকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আবার জিডিপির দিক থেকেও ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে যখন দেশ পাকিস্তান হলো তখন মৌলিক কাজগুলো হতো মূলত পশ্চিম পাকিস্তানে। এমনকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ. কে. ফজলুল হক সাহেব সহ বড় বড় সেসব নেতা ছিলেন তারা পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে জায়গা পাননি। ১৯৪৮ সালে যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ তখন এখানকার মানুষ তার তীব্র প্রতিবাদ করল। কারণ তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সাড়ে সাত শতাংশ মানুষের মাতৃভাষাই ছিল উর্দু, আর ৫৫ শতাংশের ভাষা ছিল বাংলা। জিন্নাহর এই ঘোষণার বিরোধীতা করার বা দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে দুটো ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে আরেকটা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল দাতব্য সংস্থার। কিন্তু দেখা গেল ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই ১৯৫৮ সালের সংবিধানে আইয়ুব খান নিজেই বাতিল করে দিলেন। পরবর্তীতে ২১ দিন পর আইয়ুব খান নিজেই ক্ষমতা নিয়ে নিলেন। মার্শাল ল জারি করলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক নেতাকে বন্দী করলেন, জেলে পাঠালেন। ১৯৫০ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক শোষণ চাপানো হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ ছিল পাকিস্তানের রাজধানী প্রথমে ছিল প্রথমে করাচি, তারপর ছিল রাওয়ালপিন্ডি, সর্বশেষ ছিল ইসলামাবাদ। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সব খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের। সৈন্যবাহিনী, সেক্রেটারি সবকিছু পশ্চিম পাকিস্তানে। আর যে সব ব্যবসায়ী এসেছিলেন পাকিস্তানে তাদের বেশির ভাগ বোম্বে, মহারাষ্ট্রে থেকে এসেছিলেন । তারাই এসেই পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসাটা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছিল এবং সে সময় পাকিস্তানের প্রধান অর্থকরি ফসল ছিল না সিনথেটিক ফাইবার। এখন যেমন পোশাকশিল্প। বর্তমানে পোশাকশিল্পে ৩০ বিলিয়ন ডলার আমদানি হয়। বর্তমানে পাট পাকিস্তানের প্রধান জৈবিক অর্থকরি ফসল। ১৯৬০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত পাটই ছিল সারাবিশ্বের প্রধান প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল।
পাকিস্তানের প্রধান অর্থকরি পাট বিক্রি করে যে আয় হতো তার সামান্যই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য খরচ হতো। বাদবাকি পুরো অর্থই খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করলেন ১৯৬৬ সালে। তিনি ঘোষণা করলেন পশ্চিম পাকিস্তান যেন কোনোভাবেই পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তানে দুটি মুদ্রা লাগবে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে কেবলমাত্র পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাকি সবগুলো থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। (চলবেÑ০১)
পরিচিতি: উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য , আওয়ামী-লীগ
মতামত গ্রহণ: ফাতেমা-তুজ-জোহরা
সম্পাদনা: আশিক রহমান