ছয় দিনের যুদ্ধ ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে মুসলিম বিশ্ব
রাহাত মিনহাজ
১৯৪৮ সালে বিশ্বশান্তির বিষক্ষত ইসরাইলের জন্ম। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি আর্থার জেমস্ বেলফোরের প্রচেষ্টায় গৃহীত হয় বেলফোর ঘোষণা। যার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদি রাষ্ট্রটি। এর আগ পর্যন্ত ওই অঞ্চলে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। জাতিসংঘের প্রস্তাব নম্বর ১৮১-এর মাধ্যমে এই দেশটির প্রতিষ্ঠা। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ৪২ ভাগ ভূমি ফিলিস্তিনিদের জন্য আর ৫৩ ভাগ ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয় ইহুদিদের। আর জেরুজালেমকে রাখা হয় উন্মুক্ত ভূমি হিসেবে। এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি ফিলিস্তিন। অন্যদিকে নানা অজুহাতে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাসগৃহ থেকে আরবদের উচ্ছেদ শুরু করে ইহুদিরা। অনেকে আশ্রয় নেন জর্ডানে। শুরু হয় এক সংঘাত। যে সংঘাত আজও চলছে। যার ধারাবাহিকতা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে মুসলিম বিশ্ব।
মুসলিমদের পবিত্র ভূমি থেকে আরবদের উচ্ছেদ ও ইহুদি আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল আরবরা। ভেতরে ভেতরে এই রাষ্ট্রটিতে চরম এক শিক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিল বেশ কয়েকটি দেশ। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল গামাল আব্দেলে নাসেরের মিসর। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে মুসলিম বিশ্বে অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা ছিলেন নাসের। নাসের ইহুদিদের পরাজিত করে মুসিলম বিশ্বের অন্যতম কালজয়ী নেতাতে পরিণত হতে চেয়েছিলেন। যে কারণেই তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে গোপনে গোপনে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। যার সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে সিনাই উপত্যকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের সেনাদের সরিয়ে নিতে জাতিসংঘকে চিঠি দেন নাসের। এদিকে মিসরের সেনাবাহিনী চূড়ান্ত যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে যুদ্ধ যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় সিরিয়া ও জর্ডান। আরব এই তিন দেশের যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা আগেই নিশ্চিত হয় ইসরাইল। এরপর ১৯৬৭ সালের ৫ জুন প্রথম মিসরের লক্ষ্যবস্তুতে তীব্র আক্রমণ চালায় ইসরাইলি সেনারা। এতে প্রথম দিনেই মাত্র ঘণ্টার ব্যবধানে মিসরীয় বিমানবাহিনীর ৯০ শতাংশ সামর্থ্য ধ্বংস হয়ে যায়। একইসঙ্গে আক্রমণ পরিচালিত হয় জর্ডান, ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ায়। মাত্র ছয় দিনের এই যুদ্ধে সিনাই উপদ্বীপ, গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ইসরাইলের কাছে পদানত হয়। পুরোপুরি ইসরাইলি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় গোলান মালভূমির উপর। মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে সব ফ্রন্টেই চরম মার খায় আরব যোদ্ধারা। দিশেহারা হয়ে পড়েন নাসের। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ থামাতে ৬ দিন পর জাতিসংঘের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নেয় মিসর। শেষ হয় কলঙ্কজনক এক যুদ্ধের। এরপর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি আধিপত্য আরও বেড়ে যায়। আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রটি হয়ে পড়ে আরও অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু কেন এই যুদ্ধে এত নিদারূপ পরাজয় আরব বিশ্বের? এই প্রশ্নের জবাবে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বারবারই বলেছেন নাসেরে কথা। নাসের চেয়েছিলেন ইসরাইলকে পরাজিত করে মুসলিম বিশ্বের একক নায়ক হতে। কিন্তু তার পরিকল্পনা ও শত্রুর সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই কম। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের অনৈক্যও এর পেছনে কাজ করেছে। যার বলি হিসেবে মিসরকে হারাতে হয় ১০-১৫ হাজার সেনা। আর জর্ডানে নিহত হয় ছয় হাজারের মতো সেনা সদস্য। ব্যাপক ক্ষতি হয় আরব দেশগুলোর সেনাবাহিনীর। তবে মনে রাখা ভাল ১৯৬৭ সালের এই যুদ্ধই শেষ নয়। এরপর ১৯৭৩ সালে মিসর আবার ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়। মূলত সুয়েজ খাল নিয়ে এই যুদ্ধ পরিচিত ছিল ইয়াম কাপ্পুর নামে। স্বল্প সময়ের এই যুদ্ধে মিসরের সঙ্গে ছিল সিরিয়া। তবে ১৯৬৭ সালের মতো এই যুদ্ধেও পরাজিত হয় আরব দেশ দুটি। আরও শক্তিশালী হয় ইহুদি আধিপত্যবাদ। ১৯৬৭ সালে নাসের যেমন ভুল করে পুরো আরব বিশ্বকে ডুবিয়েছিলেন এবার পরাজিত যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আনোয়ার সা’দত। যদিও পরাজিত হওয়ার পর এই সা’দত ১৯৭৮ সালে ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তি সই করেন। যাকে মুসলিম বিশ্বের নেতারা অভিহিত করেছিলেন ভাই হয়ে পিঠে ধারালো ছুরি বসিয়ে দেওয়ার সঙ্গে।
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান