কুরআনের আলোকে মাহে রমজান
া হামীম আফফান শাহীন
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতেপার। (সুরা বাকারা: ১৮৩)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন, প্রথমত রোজা সবসময় সব মুমিনদের জন্য ইবাদত। রোজা মূল মাকসাদ তাকওয়া অর্জন। দ্বিতীয়ত এ রোজার মাধ্যমে আমরা যদি তাকওয়া অর্জন না করতে পারি, তাহলে এ রোজা কেবল উপহাস মাত্র। আল্লাহর কাছে এর কোনো প্রতিদান নেই। রোজা ফার্সী শব্দ। এর বাংলা সাধনা। আরবিতে বলে সিয়াম। এই সিয়াম বা সাধনা মহান রাব্বুল আলামিনের এমন এক বিধান যা শুধু ইসলামেরই নয়,বরং পূর্ববর্তী ধর্মগুলোতেও এ নিয়ম ছিল।
রোজার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে
রোজা হল একটি পরোক্ষত ইবাদত। কিন্তু নামাজ জাকাত কুরবানি ও হজ এসব দৃশ্যমান ইবাদত। রোজা অপ্রকাশ্য ইবাদত বলে তা দ্বারা রিয়া প্রকাশ করার সম্ভাবনা নেই। রোজা মানুষের ইচ্ছাশক্তি প্রবল করে। যারা মাসব্যাপী দিনের বেলায় সব ধরনের পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকে, তারা অন্যের ধন সম্পদ থেকে নিজেদের লোভ দমন করতে সক্ষম হয়। রোজা মানুষকে উদার হতে শেখায়। যারা একমাস ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করে তারা ক্ষুধার্তদের কষ্ট বুঝতে পারে এবং তাদের নিয়ে ভাবে ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। রোজা গুনাহ বা পাপ বর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
রোজা মুমীনের ইবাদত। রোজা মানুষের মধ্যে তাকওয়া বৃদ্ধি করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, রোজা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য ফরজ। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় ওই সংখ্যক রোজা রাখতে হবে। রোজা যাদের জন্য কষ্টদায়ক যেমন অতি বৃদ্ধদের জন্য, তারা অবশ্যই একজন অভাবগ্রস্তকে অন্নদান করবে। (সুরা বাকারা: ৮৪) একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর বিধান কষ্টদায়ক কিংবা মানুষের সাধ্যাতীত নয়। বরং প্রত্যেকেই তার ক্ষমতা-সাধ্য ও শক্তি অনুযায়ী আল্লাহর বিধান পালন করতে পারে। যেমন সারা বছরের মধ্যে মাত্র এক মাস রোজা রাখা ফরজ। এই মাসে কেউ যদি সফরে বা অসুস্থ থাকে তাহলে তাকে অন্য কোন মাসে রোজা রাখতে হবে। আর যদি কোন মাসেই রোজা রাখার ক্ষমতা তার না থাকে তাহলে রোজা রেখে ক্ষুধা সহ্য করার বদলে ক্ষুধার্তকে স্মরণ করে প্রতিটি রোজার বদলে প্রতিদিন একজন অসহায় মিসকিনকে উদরভরে খাওয়াতে হবে।
হাশরের ময়দান। মহান আল্লাহ একেক করে সবাইকে ডাকবেন। জিজ্ঞেস করবেন, তার কৃতকর্ম সম্পর্কে। সর্বপ্রথম ডাকবেন ধর্মযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী একজন শহিদকে। স্মরণ করিয়ে দিবেন দুনিয়ায় প্রদত্ত বিভিন্ন নেয়ামতসমূহের কথা। এরপর বলবেন, ‘দুনিয়াতে তোমার কি আমল রয়েছে? উত্তরে সে বলবে, ‘আমি আপনার সন্তুষ্টির নিমিত্তে কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি এবং শহিদ হয়েছি।’ আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘ এটা তোমার মনগড়া উত্তর। তুমি আমাকে সন্তুষ্টি করার জন্য যুদ্ধ করনি। বরং মানুষ তোমাকে বীর-বাহাদুর বলবে, সে কারণে যুদ্ধ করেছ। এবং তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী সে খ্যাতি তোমার প্রাপ্তও হয়েছে। এখন শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও।’ তারপর ফেরেশতারা তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
এরপর উপস্থিত করা হবে একজন আলেমকে। যার প্রসিদ্ধি ছিল চারদিক। সুনাম ছড়িয়ে যেত দেশ হতে দেশান্তরে। লোকেরা তার বয়ান শুনা বা কিছু শিখবার জন্য ছুটে আসত দূরদূরান্ত থেকে। মহান আল্লাহ তাকে দুনিয়ার নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, ‘এ নেয়ামতের বদৌলতে আমার প্রতি তোমার কৃতজ্ঞতা কেমন ছিল?’ সে অকপটে বলতে থাকবে, ‘আমি ইসলামি জ্ঞান শিক্ষা করেছি, এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছি। বয়ানের মাধ্যমে মানুষদের হেদায়াতের পথে আনার চেষ্টা করেছি। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেছি।
অন্যকে শিক্ষাও দিয়েছি। এ সব করেছি একমাত্র আপনাকে খুশি করার জন্য’ আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘ তুমি মিথ্যা বলেছ। মানুষ তোমাকে জ্ঞানী বলবে, সে জন্য ইলম শিখেছ। মানুষ তোমাকে বক্তা বলবে, সে জন্য বয়ান করেছ। মানুষ তোমাকে ক্বারী বলবে, সে জন্য কুরআন তেলাওয়াত করেছ। সুতরাং তোমার অভিপ্রায় অনুযায়ী তোমাকে সে খ্যাতিও দান করা হয়েছে।’ এরপর আল্লাহ বলবেন, তাকে নিক্ষেপ কর জাহান্নামের নি¤œ স্তরে। ফেরেশতারা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
এরপর আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে অঢেল সম্পদের অধিকারী এক ব্যক্তিকে। তাকেও পূর্বের ন্যায় নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিবেন। জিজ্ঞেস করবেন, এ সম্পদের বিনিময়ে আমার কৃতজ্ঞতা কিভাবে আদায় করেছ? তৎক্ষণাৎ সে দিব্যি বলে যাবে, ‘আমার সকল সম্পদ আপনার রাস্তায় ব্যয় করেছি।
আপনার পথের পথিককে দিয়েছি। মসজিদ মাদরাসায় সব জায়গায় খরচ করেছি। আর তা কেবলই ছিল আপনাকে সন্তুষ্টি করার জন্য।’ কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘ তুমি একদম মিথ্যা বললে।
তুমি আমাকে খুশি করার জন্য ধনসম্পদ ব্যয় করো নাই। বরং মানুষ তোমাকে দানশীল বলবে, তোমার খ্যাতি ছড়াবে ; তোমার উদ্দেশ্য ছিল এমনটি। সুতরাং সে ইচ্ছা অনুপাতে তোমাকে দুনিয়ায় তা দেওয়া হয়েছে। এখন তোমার কোন পুণ্য নেই। তোমার ঠিকানা জাহান্নাম। তারপর ফেরেশতারা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (মুসলিম: ১৯০৫)
লোক দেখানো আমল মহান আল্লাহর কাছে কখনোই গ্রহণীয় নয়। চাই তা সামাজিক কিংবা পারিবারিক, বাহ্যিক কিংবা অভ্যন্তরীণ, রাষ্ট্র পরিচালনা কিংবা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা ইত্যাদি যেকোন বিষয় হোক না কেন। আমাদের মাঝে লৌকিকতার প্রবণতা শিরা উপশিরায় ঢুকে পড়েছে। সুতরাং এ থেকে বিরত থাকা একজন মুমিন মুসলমানের জন্য অত্যন্ত জরুরি।