কাঙালপনার অবাক কাহন
কাকন রেজা
‘বাঙ্গালীগো ইশকুলে বাংলা নাই। শুনতে কেমুন লাগে কথাডা। চক্ষু দুইখান কপালে উডে। উডবারতো পারেই, অনেকতে কয় বাংলা থাহে অগো ওইপারেতে। অরাই বাঙ্গালী, আমরাতো বাঙ্গাল, মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, আমাগো ইশকুলই নাই।’
’৪৭ পূর্ব চিত্রকল্প এটি। যখন কথিত বাঙালিরা ধুতি ছেড়ে পাতলুন, জামা ছেড়ে কোট ধরতে শুরু করেছেন। চারিদিকে ইংলিশ মিডিয়ামের জয়জয়কার। পাইপ টেনে ফুটফাট ইংরেজিতে বাবুরা যখন বুদ্ধিজীবী সাজে বাঙালদের কাবু করতে মরিয়া, এই চিত্রকল্প সেই সময়ের। বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নে আমিও মাঝেমাঝে ‘আউলা’ হয়ে যাই। কেউ কেউ যখন বাঙালি এবং ধর্ম এ নিয়ে খটমট বাঁধিয়ে দেন তখন আরও বেশি আউলা হই। ‘বাঙালি হলে মুসলমানিত্ব থাকবে না, মুসলমান হলে যাবে বাঙালিত্ব’ এমন চিন্তায় কারও কারও চান্দি গরম হয়ে যায়। এমন গরম চান্দি প্রসবিত কিছু বাক্যে প্রায়শই ভয় দেখি, বাঙালিত্ব হারানোর ভয়। আরে ভাই বাঙালিত্ব কী কোনো পদ, যা হারানোর ভয়ে সবসময় কম্পমান থাকতে হবে! প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আরে ভাই আপনি বাঙালি হলেন কবে? আপনাকে কে এই পদবি দিল, ভেবে দেখেছেন কী? বাঙাল ছিলেন ভালো ছিলেন, কাঙাল হলেন কবে? কাঙালদের এই প্রশ্ন করেই লাভ কী? যাদের লক্ষ্য স্তুতি, স্তাবকতা। যাদের লক্ষ্য আনন্দবাজারীদের বাজার ধরা, তাদের বলেই কী আন্ডা হবে। তার চেয়ে ঠা-া থাকাই ভালো। নবরতœ তেল মেখে একেবারে ‘ঠা-া ঠা-া কুল কুল’।
তবে ঠা-া থাকতে দিল না সাম্প্রতিক একটি সংবাদ। দৈনিক মানবজমিনের কলকাতা প্রতিনিধি জানালেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের সব স্কুলে বাংলা আবশ্যিক করতে বিল আনা হচ্ছে।’ কী আচানক শিরোনাম! কদিন পরে মমতা দিদিও হুংকার দিলেন, বাংলা পড়াতেই হবে! বাঙালিদের তীর্থধামে বাংলাকে আবশ্যিক করতে আইন জারির সিদ্ধান্ত নিতে হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে হুংকার ছাড়তে হয়! তাহলে এতদিন সেখানে বাংলা নির্বাসিত ছিল? সেখানের স্কুলে কী ছিল, সংস্কৃত, হিন্দি না মারাঠি? আমি জানি না, আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ জানতে পারেন। তবে ভারতাধীন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন পাততাড়াতাড়ি বাংলা আবশ্যিক করতে বিধান সভায় বিল আনতে যাচ্ছে রাজ্য সরকার। এখানেও প্রশ্ন রয়েছে, এতদিন কী রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার চালিয়েছে! যে রাজ্যের নামের শেষে বঙ্গ, অধুনা ‘বাংলা’ নাম চালুতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে স্কুলে বাংলা চালু করতে এতদিনে আইন করতে হয়, সেল্যুকাস! আমাদের যারা ওপারের বইমেলাতে যান, যারা গরদের পাঞ্জাবির উপর ‘উ’তে উত্তরীয় চাপিয়ে বিগলিত বাক্যচয়ন করেন, এ ব্যাপারে তাদের অনুভূতি কী বড় জানতে ইচ্ছা করে। আমাদের বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের চমকে দেওয়ার জন্য এই সংবাদের আরেকটি অংশে রয়েছে, ‘এ বছর রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন কলকাতা শহরের একাধিক স্কুলে উদযাপন হয়নি। সে কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।’ বলে কী! খোদ কলকাতাতেই রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থা, ‘ইহা’ও সেল্যুকাস! অথচ এই ভূখ-ে রবীন্দ্রনাথ না পড়লে, না মানলে সভ্য হওয়া যায় না। রীতিমতো বাঙালিত্ব খারিজ হয়ে যায়, প্রতিক্রিয়াশীলের তকমা জোটে। এখানে সভ্যতা ও প্রগতির মাপকাঠি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ। না মানলে বাঙালিত্ব খারিজ। বলতে পারেন, ‘ইহাও’ সেল্যুকাস বটে।
ভাইরে বাঙালিত্ব না হয় খারিজ করলেন, বাঙালত্ব খারিজ করবেন কী দিয়ে। ‘ঢাকার ভানু’র পরিচয় মুছবেন কী দিয়ে? ‘বাঙাল শুটকি মাছের কাঙাল’ এমন ছড়া ভুলবেন কী করে? ‘এ মা ওরা তো ম্লেছ, বাঙাল’, বাঙালদের ছোট করতে ‘ঘটি’দের এমন অবজ্ঞা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভোলাবেন কী দিয়ে? কোনোডা দিয়াই ভুলতে বা ভুলাইতে পারবেন না। ভুলাইতে গেলে যে নিজেরেই ভুইলা যাইতে হইবো, হয়। ‘ঢাকা ভার্সিটি’রে উডাইয়া দেওন লাগে। চাষবাস করা চাষার পোলাগো ‘ভার্সিটি’র কী দরকার, ‘ভার্সিটি’ থাকবো বাংলার তীর্থে, এইডা মাইনা লইতে হয়। তাই কই, প্যাচাইলে কাম হইবো না, অহন বাঙালের পোলাগোরও বুদ্ধিশুদ্ধি হইছে। তাগো মাথাডা ‘মাথা বেচাগো’ মাথার উপর দিয়া জাগছে। অহন আর দাবায়া রাখন যাইবো না, দাবায়া রাখতে পারবো না। ‘বাংলা ভাষা’র পূণ্যভূমি সবসময় ‘বাঙাল’দের এই ‘বাংলা’ই ছিল, এখনো আছে, থাকবে। বাংলার উৎকর্ষতা নিয়ে যে ‘গালগপ্প’ চালু আছে ওই বাংলায়, তাও এই বাংলার দাক্ষিণ্য নিয়েই, এই বাংলাকে দাবিয়ে রেখেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান