বন্ধ হোক অপ্রয়োজনীয় পেইন কিলারের ব্যবহার
ডা. জাকির হোসেন
গ্রাম অঞ্চলে বেশিরভাগ নারী পুরুষই শ্রমজীবী। তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দিন-রাত ক্ষেতে খামারে কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই দিন শেষে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে শরীরের মাংস পেশী এবং হাড়ের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা শুরু হয়। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই জানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ফ্রিতে শরীর ব্যথার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ এই সকল পেইন কিলারের জন্য ভিড় করেন। নবীন চিকিৎসক হিসেবে চাকরির শুরুর দিকে রোগীদের অসুস্থতা নির্ণয় করে একটি ব্যবস্থাপত্রে প্রযোজনীয় ওষুধ লিখে দিতাম। যেখানে পেইন কিলারের প্রয়োজন হতো না সেখানে পেইন কিলার লিখতাম না। কিন্তু বিধি বাম। কে শোনে কার কথা। লোকজন যাচ্ছেতাই দুর্ব্যবহার করা শুরু করল এই সকল পেইন কিলার তাদের সরবরাহ না করার কারণে।
কিছুদিন যেতে না যেতেই অনেকেই বলতে দেখি চিকিৎসকেরা ওষুধ মেরে দেয়। কথায় বলে উপকারীরে বাঘে খায়। যেহেতু একেবারেই নবীন চিকিৎসক আমি, সামগ্রিক বিষয়গুলো উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তার সঙ্গে শেয়ার করলাম। উনি আমায় বেশকিছু পরামর্শ দিলেন। তার কথায় বুঝতে বাকি রইল না, আমার চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগ এই জরাজীর্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দেওয়া সম্ভব না। বুঝতে পারলাম এই ভঙ্গুর কাঠামো দিয়ে কোনোদিনই এই সহজ-সরল মানুষগুলোকে পেইন কিলারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বোঝানো সম্ভব নয়। তারা বোঝবে না ব্যথা কোনো রোগ নয়, এটি উপসর্গ মাত্র। কোনো রোগ বা চোটের কারণে ব্যথা হচ্ছে, তা অবশ্যই ডাক্তারকে দেখিয়ে জানতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শবিহীন এই সকল পেইন কিলারের কারণে কিডনি অকেজো, পেটে ব্লিডিং, গ্যাসট্রিকের সমস্যা, হাই ব্লাড প্রেসার, হার্টে প্রভাব, বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। ডায়াবেটিক রোগীদের শরীরে দ্রুত প্রভাব পড়ে।
সাময়িক আরামের জন্য যথেচ্ছ পেইন কিলারের ব্যবহারের কারণে কত নিরীহ মানুষ দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের দেশে নেই। এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য দায়ী কে? কেউ সদুত্তর দিতে পারবে না। সরকারি কর্তাব্যক্তি ও আমলারা কেউই এগুলোতে চিকিৎসা নেন না। সরকারি লোকেরা দেশে প্রাপ্ত এই চিকিৎসাসেবা না নিয়ে সামান্য কারণে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর অথবা ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যান সরকারি খরচে। এ রকম উচ্চ সরকারি পদাধিকারীর অভাব নেই, যারা চিকিৎসার জন্য নয়, স্বাস্থ্য পরীক্ষার অজুহাতেও বিদেশে যান। তাদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার এই সহজলভ্যতার কারণে দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা বা অব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাতের কোনো প্রয়োজনবোধ তাদের থাকে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যস্বাস্থ্য প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে পারলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এই সকল নিরীহ জনগণ। কমে আসবে দেশের মানুষের অপ্রয়োজনীয় পেইন কিলারের ব্যবহার।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান