ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে জরুরি গণজাগরণ
মোহাম্মদ আবু নোমান
যে হাতে শিশুদের বই, খাতা-কলম, খেলার সমাগ্রী থাকার কথা, আমাদের সেই হৃদয়ের ফুল, মানব উদ্যানের হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য, গোলাপের মতো সুন্দর, হাসনাহেনার মতো সুগন্ধি ছড়ানো নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ হৃদয়ের বাঁধন, নয়নের পুত্তলি, অতি আদরের সোনামণি তথা শিশু-কিশোরদের হাতে আজ তারা উঠিয়ে নিয়েছে হাতুড়ি; ভাঙছে ইট, পাথর, শিশু শ্রমিক হয়ে কাজ করছে ওরা। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একজোটে কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগাতেই ১২ জুন পালিত হয় ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’। বিভিন্ন ছোট-বড় কলকারখায় শিশুরা অমানবিক শ্রম দেওয়া ছাড়াও তাদের ওপর নানা নির্যাতন চালানো হয়। শিশুরা ঝালাই ও ঢালাই কারখানা, রি-রোলিং মিলের লোহা গলানোর কাজে, এমনকি জ্বলন্ত বয়লারের পাশে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করে। সুযোগ ও সচেতনতার অভাবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিসেবার চিকিৎসাসেবাও এরা পায় না। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুরা নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। অদক্ষ বলে তাদের উপর চলে অকথ্য নিপীড়ন। সামান্যতম অমনোযোগের অভিযোগে মারপিট ও অত্যাচার এতটাই নির্মম হয়, কখনো কখনো তা মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি শিশুকে আদর্শ নাগরিক ও জাতির কর্ণধার হিসেবে গড়ে তুলতে বড়দের রয়েছে নানা দায়-দায়িত্ব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না শিশুদেরও অপমানবোধ ও সম্মানবোধ আছে। শিশুদের প্রতিটি অধিকার সুনিশ্চিত করাসহ তাদের স্কুলে যাওয়া ও মেধা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তাদের সুস্থ বিনোদনসহ খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। একটি শিশুও যেন ঝরে না পড়ে, রাস্তায় ঘুরে না বেড়ায়। শিশুদের খাদ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা দেওয়া সকলের দায়িত্ব।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী একটি শিশুকেও তার জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনোপ্রকার শ্রমে নিয়োজিত করার কথা নয়। বাংলাদেশের শ্রম অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৪৯ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। বাস্তবে তার সংখ্যা ৫২ লাখের উপরে। আইএলওর এক সমীক্ষায় ৭০৯টি ফ্যাক্টরির মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, মোট ৯ হাজার ১৯৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪১.৫ ভাগ অর্থাৎ ৩৮২০ শিশু। এই শিশু শ্রমিকদের অধিকাংশেরই বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই মানা হচ্ছে না শ্রম আইন। শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে আইন করা হলেও তার যথার্থ প্রয়োগ নেই। ফলে আইন অমান্য করে মালিকপক্ষ অত্যন্ত কম বেতনে শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে। শিশু শ্রমের ওপর বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ৪৫ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৪১ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ। শুধুমাত্র একবেলা খাবার জোগাড় করতে শিশুরা দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে।
শিশুদের সুস্থ পরিবেশে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারলে সমাজ অন্ধকারের দিকে যাবে। আইনি ব্যবস্থা আরও কঠোর হওয়া দরকার। দরকার তাদের সুস্থ সাবলীলভাবে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা। তাই শুধুমাত্র সভা আর সেমিনার নয় আসুন প্রকৃত শিশুকল্যাণে কাজ করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক/সম্পাদনা: আশিক রহমান