বাবা দেখো, তোমার মেয়েটা ফিরে এসেছে!
প্রতীক ইজাজ
রাজনীতি, সমাজ, দেশ। টানাপড়েনের সংসার। সারাদিন ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। এরই মাঝে খবরটা এলো সেদিন। ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে না মেয়েটাকে। জীবন পেল। পেল বটে, তবে আকাশে ডানা মেলে ওড়া হলো না। ভাসা হলো না ছেড়া ঘুড়ির পেছনে ছেড়া মেঘ হয়ে। বাঁধা হলো না গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ। অথচ এখন তো তার পুরোটা বিকেল ঘাস ফড়িঙের পেছনে ছোটার কথা। জানালা গলে জল টলটল পুকুরের কচুরিপানার ফুলে ডুব দেওয়ার কথা। আর চোখে মুখে জারুলের রং মেখে লুটোপুটি খাওয়ার কথা গল্পে, আনন্দে, সবুজ ঘাসে। হ্যাঁ, আমি কিশোরী ঐশীর কথায় বলছি। ওর জন্য মনটা খারাপ। মা-বাবাকে হত্যার অপরাধে প্রথমে ওর ফাঁসির রায় হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে। তার মানে মেয়েটা বাঁচল। প্রাণ পেল। কিন্তু কি লাভ এ বেঁচে থাকায়! আদালতের চোখে ঐশী অপরাধী, জানি। কিন্তু মানতে পারিনি। পারছি না। বারবার ঘুরে-ফিরে আসছে সবুজে স্নাত সেই মুখ, যে ঐশী স্বপ্নের ডানায় ভেসে, হুল্লোড় জুড়ে, মাথায় তুলে রাখছে বাড়িটা। কারণে-অকারণে, আবদারে-অনাবদারে, পোষা বেড়াল ছানার মতো ঘুরঘুর করছে মা-বাবার শরীর ঘেষে। গান গাইছে। পড়ছে। শরীরে জড়িয়ে নতুন পোশাক, আনন্দে নাচছে আয়নার সামনে।
আমি ঐশীকে দেখিনি। কথাও হয়নি। কিন্তু জেনেছি। উপলব্ধি করেছি। ওর চোখ কথা বলে। বুদ্ধিদীপ্ত গভীর চোখ। মুখে প্রতিভার রেখা স্পষ্ট। চলন-বলন, তাকানো, মুখভঙ্গিÑ অবিকল আমাদের ঘরের ঐশীর মতো। প্রতিদিন সকালে যে মেয়েটির আহ্লাদী বাঁকানো গ্রিবা দেখে ঘুম ভাঙে আমাদের, ঐশী তো সেই আদুরে মেয়ে। আদুরে মানে, আমাদের ঘরেরই মেয়ে। আমরা ওকে দেখে রাখতে পারিনি। যতœ দিতে পারিনি। ওকে বুঝতে পারিনি। ও কষ্ট পেয়েছে। আমরা এড়িয়ে গেছি। ও কিছু বলতে চেয়েছে। আমরা শুনিনি। আমরা ওকে মেপেছি চাহিদার নিক্তিতে, অর্থের বাটখারায়। ওর অভিমান, আবেগ, উচ্ছ্বাসÑ আমাদের কাছে মূল্য পায়নি। আমরা ওর বেড়ে ওঠা বুঝিনি। শরীরের বাঁক বদল টের পাইনি। কাছে টানার বদলে মেয়েটাকে দূরে ঢেলে দিয়েছি। দূরে দূরে রেখেছি। সে দূরের দূরত্ব কতটাÑ বুঝিনি। বুঝেছে ওরা, ওরা মানে অশুভ সময়, ঘৃণ্য চক্র। পথ খুলে দিয়েছে। ধীরে ধীরে মেয়েটাকে পাল্লায় ভিড়িয়েছে। মাদকাসক্ত করেছে। নিজে সেবন করেছে। ওদের হয়ে বাড়িয়েছে খদ্দের। এক সময় এতটুকুন একটা মেয়ে, মোহে পড়েছে অর্থের। সে অর্থ নিশ্চয়তা দিয়েছে আরও বেশি মাদকের। ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে নিষিদ্ধ অলিগলিতে। আমরা বুঝিনি। বুঝতে চাইনি। ডাকিনি কাছে। কোনো এক সন্ধ্যায় বা রাতে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শুনিনি মেয়েটির না বলা গল্প। মেয়েটাও উচ্ছন্নে গেল। ঘুমঘুম চোখে-মুখে বড় অচেনা হয়ে গেল ঘর-সংসার-স্বজন। ততদিনে বিক্রি হয়ে গেছে চেনা শহর, প্রিয় পড়ার ঘর, গাছগাছালিতে ঢাকা সবুজ বারান্দাটাও। বিক্রি হয়ে গেছে আদর-স্নেহ-মমতা। সময়ের পিছু পিছু মেয়েটাও একদিন পাড়ি জমায় অবিশ্বাসে, সন্দেহের দেশে। একদিন ঘুম ভাঙে আমাদের। মেয়েটাকে বুঝতে চাই। শাসনে ফেলি। ঘরে বাঁধি। কিন্তু খবর রাখি না সময়ের, মনের। এক সকালে শুনি মেয়েটি মা-বাবার হন্তারক। হইচই পড়ে। গণমাধ্যমে খবর বেরোয়। আমাদের টনক নড়ে। আঁৎকে উঠি ভয়ে। ঘুমন্ত মেয়েটাকে জাপটে ধরি বুকের সঙ্গে। কাঁদি। মন ফেরে ঘরে। আর ততক্ষণে মেয়েটি যাবজ্জীবনের কারাদ- নিয়ে চিহ্নিত হয় হন্তারক হিসেবে।
ঐশী এখন কাশিমপুর কারাগারে। বাইরের জগত ওর কাছে মিথ্যে। স্বজন বলতেই বা কে আছে ওর। প্রতিদিন কত মানুষ আসে সেখানে। দেখে। কাঁদে। বিদায় বেলায় শক্ত করতে গিয়ে মন, বেদনায় মুষড়ে পড়ে শরীর। কিন্তু ওর তো কেউ নেই। কে যাবে ওকে দেখতে, খোঁজ নিতে, সান্ত¡না দিতে। কে যাবে বলতে, মা, ভাবিস না, যা হওয়ার হয়ে গেছে, আমরা তো আছি। আমি জানি না, শেষ পর্যন্ত কি হবে ঐশীর। জীবনের উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিনগুলো কি ওই চার দেয়ালে এমনি করেই নিভৃতে বেদনায় কেটে যাবে; নাকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমায় মওকুফ পাবে সাজা। এক বিকেলে কারাগারের ফটক দিয়ে বেরিয়ে মুক্ত আকাশে শ্বাস ফেলে বলবেÑ বাবা, দেখোÑ তোমার মেয়েটা ফিরে এসেছে!
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী/সম্পাদনা: আশিক রহমান