বিলেতের তিন নারী হোক প্রগতির তরবারি
অজয় দাশগুপ্ত
বিলেতে বাঙালি তিন কন্যার জয়ে আনন্দিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সামাজিক মাধ্যমে এদের জয় নিয়ে যে উল্লাস ও আনন্দ আমি তা ভালোভাবে খেয়াল করেছি। এর ভেতর যতটা উন্মাদনা, যতটা আবেগ, যুক্তি ততটা কাজ করেনি। এটা আমাদের জাতীয় স্বভাব! আমাদের দেশটি মায়া ভালোবাসা বা প্রীতিতে উজ্জ্বল। কিন্তু এর আবেগের দিকটা অনিয়ন্ত্রিত বলেই প্রায় সবদিকে বিপদ ঢুকে পড়তে পারে। তাকিয়ে দেখুন সমাজজীবন, ধর্ম, রাজনীতি কোথায় বিপদ নেই? আমরাই অতি আবেগে এসব ঢোকাই। আজকে যারা রাজনীতিকে ঘৃণা করেন, মনে করেন রাজনীতি হচ্ছে সব অন্ধকার ও ভয়ের উৎস তারাই দেখছি বিলেতে বাঙালি কন্যাদের জয়ে মহাআনন্দে মেতে উঠেছেন। বিষয়টা বিপরীতমুখি। এই তিন নারী বা এভাবে বিদেশে মূলধারায় জিতে আসা বাঙালিরা যেন বিদেশে দেশীয় রাজনীতি ও দলের আমদানিকারকদের চোখ খুলে দেয়। কি জানি কোন কারণে উপমহাদেশের আর কোনো দেশের মানুষজন প্রবাসে কংগ্রেস মুসলিম লীগ ইত্যাদি না করলেও আমাদের দেশের মানুষরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত না করে থাকতে পারে না। বহিরাঙ্গিকে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী মনে হলেও আসলে ভেতরে বিএনপি আর অন্তরে জামায়াতের সংখ্যাই প্রবল। শুধু সেই দৃষ্টিকোণে নয়, সামাজিক দৃষ্টিকোণেও দেশীয় রাজনীতির আমদানি বন্ধ হওয়া উচিত। আগে ভাবতাম, আমাদের বয়সী বা মধ্যবয়সীরা এগুলো করেন নতুন বা নবীনরা করবে না। যত দিন যাচ্ছে তত দেখছি টিউলিপ রোশনারা হবার চাইতে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়া নিয়ে ঝগড়া বা তাদের হয়ে চুলোচুলিতেই আগ্রহ আমাদের।
অথচ সবাই জানে এখন তথ্য ও প্রগতির বিশ্বায়নের যুগ। এ যুগে যে যে দেশে যেখানে আছেন তার সঙ্গে মিলে নিজের কথা নিজের দেশ ও জাতির জন্য কিছু করতে না পারলে কাজ হবার নয়। এখানেও একটি সাবধানতার বিষয় আছে বৈকি। টিউলিপ তার রক্ত ও পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে বাংলাদেশের প্রগতির সঙ্গে থাকতে পারেন বলে রুপা হক আর রোশনারা আলী কি থাকতে পারবেন? কারণ এদের থাকা না থাকার কারণ তৈরি হবে আমাদের দেশের রাজনীতিতে। এদের মনোজগতে যে বাংলাদেশ বা যে ভাবমূর্তি তার সঙ্গে মিলতে না পারলে তারা কিভাবে আমাদের হয়ে কথা বলবেন? আমাদের দেশের যেসব মানুষরা এদের জয়ে সামাজিক মিডিয়া মাতিয়ে তুললেন তাদের সবাই কি নারী নেতৃত্ব চান? তারা কি আদৌ প্রস্তুত এদের আধুনিক মন ও পোশাক মানতে? আমি তো স্পষ্ট করে বলতে পারি এদের পোশাকের জন্যও তারা বাংলাদেশে ভোট পেত না। ভোটের আগে তাদের অপমান করা হতো জিয়নে ধর্ম পালনের নানা বিষয় নিয়ে। এই হিপোক্রেসি থেকে বেরোতে না পারলে বাঙালির আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এমন জয়ে মাতম ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না দেশের বাঙালির। তারপরও এরা কোনো না কোনোভাবে আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানের প্রতীক। প্রয়োজনে সময়ে হয়তো এরাই পাশে দাঁড়াবে এই দেশ ও মানুষের। টিউলিপ, রুপা হক, রোশনারার আর একটি বিপদ প্রবাসে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জামায়াত ও প্রতিক্রিয়াশীলতা। বিলেত তাদের সেফ হেভেন। সে নিরাপদ জামায়াতি আখড়া থেকে ও তিন বাঙালি নারীর জয় মূলত দেশে-বিদেশে আমাদের শক্তি ও প্রগতির জয়। অভিনন্দন। আশা করি আমরা মন ধুয়ে সাফ করে বলতে পারব: এগোও তোমরা।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান