নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার প্রধান কারণ মতবিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তিতে আপসের বিধান রাখার পরামর্শ বিচারকদের
এস এম নূর মোহাম্মদ : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার মধ্যে ৮০ ভাগই যৌতুক সংক্রান্ত। এরমধ্যে কেবল ৫ ভাগ মামলা যৌতুকের দাবিতে মারপিট করে সাধারণ জখম থেকে মৃত্যু ঘটানো পর্যন্ত। আসলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল বা স্বামীর আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে স্ত্রীর মত বিরোধের প্রেক্ষিতেই স্ত্রী স্বামী এবং তার আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় মামলা দায়ের করে। তাই এসব মামলার ক্ষেত্রে বিচারক স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে বসে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলে অনেকটা মধ্যস্থাতাকারীর ভ’মিকায় দায়িত্ব পালন করলে দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী সরকারকে একটি বিধিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হলেও তা এখনো প্রণীত হয়নি। তাই আলোচনার প্রেক্ষিতে আপসের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌতুকের মামলা নিষ্পত্তি করতে একটি গাইড লাইন উল্লেখ করে বিধিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ বাস্তবায়নে সমস্যা ও সমাধান’ শির্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে উপরোক্ত মতামত তুলে ধরেন এ সংক্রান্ত বিচারকরা। সম্প্রতি ওই সম্মেলনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। মূলত নারী নির্যাতন আইনটির কঠোরতাকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সারাদেশে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের হচ্ছে মর্মে অভিযোগ উঠছে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশ আইন কমিশনের এক গবেষণায় দেখা যায়,এই আইনের অধীনে প্রচুর মামলা বিচারাধীন। প্রতি ১০০টির মধ্যে গড়ে ১০টি মামলায় সাজা হচ্ছে। বাকি ৯০ ভাগ মামলাই মিথ্যা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের হওয়া ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৯ টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টে আলোচকরা বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৪) অর্থাৎ ধর্ষণের চেষ্টা এবং ১০ ধারায় যৌন নির্যাতনের মামলা আমলে নেওয়ার পর প্রায়ই দেখা যায় অপরাধের উপদান নেই। টাকা পয়সার লেনদেন বা জমিজমা সংক্রান্ত সমস্যা বা প্রতিপক্ষকে হয়রানী করার উদ্দেশ্যে এসব মামলা দায়ের করা হয়। তাই গ্রাম্য আদালত বা পৌর মেয়র বা সিটি করপোরেশনকে এসব অভিযোগ নিষ্পত্তির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে অপ্রয়োজনীয় মামলার সংখ্যা কমে যাবে। তবে সেখানে অভিযোগ নিষ্পত্তি সম্ভব না হলে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টরা সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারবেন মর্মে বিধান করা উচিৎ বলে মনে করেন আলোচকরা।
এছাড়া অনেক সময় যৌতুক আইন ১৯৮০ এর ৪ ধারা অনুযায়ী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকাবস্থায়ই স্ত্রী আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ১১ (খ)/(গ) ধারায় মামলা করে থাকেন। পাশাপাশি পারিবারিক আদালতে দায়ের করা হয় দেনমোহর ও ভরণ পোষণ মামলাও। এতে একই পক্ষের মধ্যে একাধিক মামলা চলমান থাকায় অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে দেরী হয়। তাই একইপক্ষগণের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কিত সকল মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একসঙ্গে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে আলোচনায় পরামর্শ দেওয়া হয়।
আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম.ইনায়েতুর রহিম বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশ্লিষ্ট সকলের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা যেভাবে প্রবর্তন করা হয়েছে অন্য কোন আইনে সেভাবে দেখা যায় না। তাই মামলা জট কমাতে এই আইনের কিছু কিছু অপরাধ আপস যোগ্য করার পরামর্শ দেন তিনি। চট্টগ্রামের (জেলা জজ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সেলিম মিয়া বলেন, আপোষ যোগ্য না হওয়ায় মামলা নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছে। তাই ৯ (৪) (খ), ১০ এবং ১১(গ) ধারার অপরাধ আপসযোগ্য করলে ট্রাইব্যুনালের মামলার সংখ্যা অর্ধেক কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অপরাধ আপস যোগ্য করার পক্ষে মত দেন নওগাঁর (জেলা জজ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আমিনুল ইসলামও। আর বগুড়ার (জেলা জজ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুল মান্নান বলেন, একইপক্ষের মধ্যে যৌতুক, বহুবিবাহ, তালাক, ভরণ-পোষণ, দেনমোহর নিয়ে ৪/৫ ধরণের মামলা বিভিন্ন আদালতে একইসময়ে চলতে থাকে। যার কারণে মামলা জট বৃদ্ধি পায়। তাই জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার আদলে বাংলাদেশেও দাম্পত্য সম্পর্কিত সব মামলা একটি আদালতে নিষ্পত্তি এবং অপরাধ সমূহ আপসযোগ্য করার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া ধর্ষীতাদের মেডিক্যাল পরীক্ষা মহিলা ডাক্তার দ্বারা করানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে বিধান করার কথা বলেন বিচারক আব্দুল মান্নান।
মুন্সিগঞ্জের (জেলা জজ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক খন্দকার হাসান মো. ফিরোজ বলেন, অনেক মামলাতেই মনোমালিন্য বা অন্যকোন বিরোধের জের হিসেবে এই ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়। অথচ এগুলো স্থানীয়ভাবেই সমাধান করা যায়। তাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু কিছু অপরাধের বিচার গ্রাম আদালতে বিচারযোগ্য হিসেবে বিধান করার পরামর্শ দেন তিনি। গাজীপুরের (জেলা জজ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সৈয়দ জাহেদ মনসুর বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারায় যৌতুকের জন্য মৃত্যুঘটানোর শাস্তি হিসেবে শুধু মৃত্যুদ-ের কথা বলা আছে। এতে ন্যায় বিচার বিঘিœত হচ্ছে জানিয়ে মৃত্যুদ-ের পাশাপাশি কারাদ- এবং জরিমানার বিধান করার পরামর্শ দেন তিনি।
গাইবান্ধার (জেলা জজ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক রতেœশ্বর বলেন, অনেক সময় দেখা যায় যৌতুকের কারণে হত্যার অভিযোগে হত্যা প্রমাণিত হলেও যৌতুকের দাবি প্রমাণিত হয় না। এ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল দ-বিধির ৩০২ ধারায় শাস্তি দিতে পারবেন কি না সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই আইনে। তাই এ বিষয়ে একটি দিক নির্দেশনা প্রদান করার দাবি জানান তিনি। এছাড়া ঢাকার ডিআইজি (প্রসিকিউশন) মাহবুবুর রহমান আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, মিথ্যা মামলার কারণে অনেক আসামি ৮/১০ বছর ধরে ট্রাইব্যুনালে ঘুরে ঘুরে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। যা মানবাধিকারের লংঘন। তাই মিথ্যা মামলার কারণে শাস্তি প্রদানের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালকে আরও উদ্যোগী হওয়ার কথা বলেন তিনি। সেইসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন সব অপরাধ আপসযোগ্য করার পরামর্শও দেন মাহবুবুর রহমান। সম্পাদনা-হুমায়ুন কবির খোকন