পাহাড়ে আগুন আর জলের মরণ নাচন
মঞ্জুরুল আলম পান্না
কান্না থামছে না পাহাড়ের। কখনো আগুন, কখনো জলের তা-ব। কখনো সমতলের মানুষের আক্রমণ, কখনো বা প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা। তবে প্রকৃতি খুব বেশি নিষ্ঠুর হয় না, যতাক্ষণ না পর্যন্ত মানুষের হিংস্রতা প্রকৃতিকে রূষ্ট করে। সোমবার পাহাড় ধসে যে শতাধিক মানুষের মৃত্যু, তার জন্য দায়ী করা হবে কাকে? নির্বিচারে পাহাড় কাটা চলে বছরের পর বছর, দিকে দিকে চলে বন উজাড়ের প্রতিযোগিতা। এই পাহাড় কাটা আর বন উজাড়ে পিছিয়ে নেই কেউ।
উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে খোদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাহাড় কাটা চলে দিনের পর দিন, পাহাড় কেটে ব্যবসায়িক স্থাপনা তৈরি করে সরকারি দলের নেতা, গড়ে ওঠে প্রভাবশালীদের টাকা বানানোর মেশিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-ক্লিনিক, বন উজাড় করে গাছপালা বিক্রি করে নগ্ন করে রাখে উঁচু উঁচু পাহাড়, টিলা কাটা হয় অবৈধভাবে বালু সংগ্রহের জন্য, টাকার বিনিময়ে সমতলের উদ্বাস্তু মানুষকে এনে রাখা হয় ক্ষত-বিক্ষত পাহাড়ের বুকে, মৃত্যুর ফাঁদে। দেখার যেন কেউ নেই।
ভয়াবহ পাহাড় ধসের পর চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের এক উপ-পরিচালক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘রাঙামাটিসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনাস্থল অধিদফতর পরিদর্শন করে দেখছে। অনেক এলাকায় পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’ কী অদ্ভূত! দিনের পর দিন এ ধরনের অবৈধ বসতি নির্মাণ চলতে থাকলেও তাদের কাছে না কি কেবল অভিযোগই ছিল। এখন তারা ডিজিটাল বাংলাদেশে হারিকেন জ্বেলে পরিদর্শনে বেরিয়েছে। এ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা কখন একজন সরকারি কমকর্তা অবলীলায় বলতে পারেন? বলতে পারেন তখনই, যখন তিনি জানেন রাষ্ট্রের প্রশাসনের কাছে জবাবদিহিতার কোনো প্রয়োজন নেই। ওই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, ‘যদি এ রকম হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় যে তারা (ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা) নিজেদের ফাঁদে নিজেরা পড়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কী নিদারুণ রসিকতা মৃত মানুষের সঙ্গে! কী ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন? যারা ঘর তুলেছিল পাহাড় কেটে তারা তো এখন ধসে পড়া পাহাড়ের নিচে। আর ঘর তুলতে সহায়তা করেছিল যে ক্ষমতাশালীরা, তাদের মতো অপরাধীদের কি শাস্তির আওতায় আনা হয় কখনো? রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চার বছর হয়ে গেলেও এখন অবৈধ সেই ভবন নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সরকারি কমকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতিও মেলে না।
বিরূপ আবহাওয়ার পূর্ব লক্ষণে আগাম কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়া হলে অন্তত এত মানুষের প্রাণহানি ঘটত না পাহাড়ের বুকে। ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করার পরও কেউ সরেনি বলে দাবি রাঙামাটির জেলা প্রশাসকেরন। তার এই দাবি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিবেশ হত্যার আয়োজন চলছে মহাসমারোহে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা, রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। কিন্তু পরিবেশের প্রতিশোধ থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। কে করবে কার বিচার?
প্রকৃতির ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ প্রকৃতি নিজেই নিয়ে নেয় সময়ের হিসেবে। মনে পড়ছে বাংলাদেশের ফুঁসফুঁস সুন্দরবনের কথা। দিনের পর দিন সেখানকার গাছপালা উজাড় হয়ে চলেছে। এরই মধ্যে এর আশপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট বড় শিল্প কারখানা। বিষাক্ত হয়ে উঠছে পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। আর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নের নামে সুন্দরবনের খুব কাছেই যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হতে চলেছে পরিবেশের কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই খোদ রাষ্ট্রীয় আয়োজনে, তার বিপরীতে প্রকৃতি যে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে তা দেখতেও হয়তো খুব বেশি সময় লাগবে না। তাতে কার কী? আমাদের পরম সৌভাগ্যÑ ‘সুন্দরবন যে দেশে নাই, সেই দেশ কী চলে না’, সাহস করে এমন কথা বলার মতো সংসদ সদস্যও এদেশে রয়েছে। বাহ! তাই মানুষের মৃত্যু কী আর এমন বড় বিষয়!
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান