শবে কদরের তাৎপর্য ও ফজিলতা
মাহমুদুল হক জালীস : রহমত, মাগফিরাত ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল। উপস্থিত হল নাজাতের মহেন্দ্রক্ষ । পাপিতাপি মুসলমান ব্যাকুল হয়ে পড়ছে পাপ মোছনের কাজে। খোঁজে বেড়াচ্ছে শেষ দশকের বেজোড় রজনী। তালাশ করছে মহিমান্বিত শবে কদরকে। পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার মহান রাতকে । মূলত কুরআন নাজিল হওয়াকে কেন্দ্র করেই রমজান মাস কিংবা শবে কদরের এতো গুরুত্ব ও তাৎপর্য। পবিত্র কুরআন যদি রমজান ব্যতীত অন্য কোন মাসে নাজিল হতো, তাহলে ঐ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত শবে কদরের মতোই থাকতো। শবে কদরের এক রাতের ইবাদতকে পবিত্র কুরআনে হাজার মাসের ইবাদতের থেকে উত্তম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনুপ্রাণিত করা হয়েছে বেশি বেশি ইবাদত করার জন্য।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ‘কদর’ নামে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাজিল করে শবে-কদরের গুরুত্ব অল্প কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন ‘নিশ্চয় আমি তা(অর্থাৎ কুরআন) নাজিল করেছি শবে কদরে। আপনি কি জানেন,শবে কদর কী? শবে কদর হলো হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয়, তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। শান্তিই শান্তি সেই, যা ফজর উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে’। (সূরা কদর) রমজানের শেষ দশদিনের যেকোন বেজোড় রাতে পবিত্র লাইলাতুল কদর হবে। কদরের শাব্দিক অর্থ মর্যাদা ও মাহাত্ম্য। অফুরন্ত মর্যাদা ও মাহেন্দ্রক্ষণ পরিপ্রেক্ষিতে এ রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। বিখ্যাত ইসলামিক মনীষী আবু বকর ওরবাক (রা.) বলেন, এ রাতের ইবাদত-বন্দেগীর কল্যাণে একজন নগণ্য মানুষও আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে’।
কদরের আর একটি প্রসিদ্ধ হলো তাকদীর ও হুকুম। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লেখা থাকে, এক রমজান হতে অপর রমজান পর্যন্ত তার আদান-প্রদানের হুকুম ও দায়দায়িত্ব আল্লাহপাক এ রাতেই ফেরেশতাদের দিয়ে দেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর বর্ণনামতে শবে বরাতে আল্লাহ তায়ালা এক বছরের জন্য বান্দার রুজি-রিজিক, হায়াত-মউত ও অন্যান্য তাকদিরী ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আর শবে কদরে সে সকল সিদ্ধান্তের প্রয়োগ ও রুজি-রিজিক প্রভৃতি আদান-প্রদানের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে দেন (কুরতুবী)।
মুহাদ্দিস ইবনে আবি হাতেম (রহ.) তাফসীরের ইমাম মুজাহিদ (রহ.) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসুল (সা.) একদিন সাহাবায়ে কিরামদের বৈঠকে বনি ইসরাইলের এক মুজাদিদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি এক হাজার মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরামের আফসোস হয় যে, এক হাজার মাস অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাস তো-এ যুগের অনেকে জীবনও পায় না। তাই হযরত মূসা (আ.)-এর উম্মত বনি ইসরাইলের মতো এতো অধিক সাওয়াব লাভের অবকাশও উম্মতে মুহাম্মদী (সা.)-এর নেই। সাহাবায়ে কিরামের এ আফসোস-অনুশোচনাকালে হযরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ হতে কুরআন মাজিদের সূরা কদর নিয়ে হুজুর (সা.)-এর কাছে আগমন করেন।
তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে ইবনে জরীর (রহ.) কর্তৃক অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ রয়েছে- বনি ইসরাইলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সমস্ত রাত ইবাদতে মশগুল থাকতো ও সকাল হতেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেতো এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকতো। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তায়ালা সূরা কদর নাজিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শবে কদর শুধু উম্মতে মুহাম্মদীরই বৈশিষ্ট্য। (মাযহারী)
শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে খুব অল্প কথায় ব্যাপক কথা বলা হয়েছে- শবে কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এখানে কতো হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম, তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তারপরও যদি একে কমপক্ষে এক হাজার মাস ধরা হয়, তাহলে হিসেব করলে দেখা যায় তা’ ৮৩ বছর ৪ মাস হয়ে থাকে। অর্থাৎ শুধু শবে কদরের একটি রাতে ইবাদতের দ্বারা ৮৩ বছর ৪ মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে ইবাদত করার সাওয়াব পাওয়া যাবে বলে হাদিস বিশারদগণ বলেছেন। বর্তমান পৃথিবীর মানুষ গড়ে মাত্র ৪৮ বছর হায়াত পায় বলে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে। এককভাবে দেখা গেলে প্রতীয়মান হয় যে, আশি বছরের অধিক হায়াত অনেকের ভাগ্যেই এখন আর জোটে না। সে মতে হিসেব করলে দেখা যাবে, ৮০ বছর কেউ হায়াত পেলে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা হিসেবে তার হায়াতের ৪০ বছর রাত থাকে, জাগ্রত মাত্র ৪০ বছর। এ ৪০ বছর হিসেব করলে দেখা যাবে যারা নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, তারা প্রতি ওয়াক্ত নামাজের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করেন। সে হিসেবে দৈনিক মাত্র সোয়া এক ঘন্টা সময় মানুষ ইবাদতে কাটায়। এ হিসেব মতে, সার্বসাকুল্যে দেখা যাবে ৮০ বছরের জীবদ্দশায় মাত্র ১ থেকে দেড় বছর ইবাদতে কাটানো হয়। অথচ শুধু শবে কদরে এক রাতে ইবাদতের মাধ্যমে একাধারে ৮৩ বছর ৪ মাস ইবাদতের ফজিলত পাওয়া যায়।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে- যে ব্যক্তি শবে কদরে দন্ডায়মান থেকে অর্থাৎ ইবাদত করাকে দ্বীনের হুকুম মনে করে এবং সাওয়াবের নিয়তে করে, তবে তার অতীত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তাই শবে কদরের ইবাদত মানবজীবনের পাপমুক্তি ও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য অপরিসীম কল্যাণকর। শবে কদরের ইবাদতের মধ্যে রয়েছে নফল নামাজ আদায় করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, জিকির-আজকার করা, তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করা, দরুদ শরীফ বেশি পরিমাণে পড়া, দান-সদকা করা ইত্যাদি। তাইতো প্রতিটি মুসলমানের উচিত এ রাতে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে নিজ পাপরাশি ক্ষমা করিয়ে নেয়া। কারণ, নবী করিম( সা.)বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের মতো পুণ্যময় মাস পেয়েও তার পাপরাশি ক্ষমা করিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়, তার ধ্বংস অনিবার্য। লেখক : কবি গল্পকার ও প্রাবন্ধিক