চিকিৎসা সেবা নিয়ে আর কত তেলেসমাতি!
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাÑ মানুষের ৫টি মৌলিক চাহিদা। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে এদেশের মানুষকে অনেক কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় সেই পূরণ করতে পারে, অনেক সময় তা সম্ভব হয় না। কোনোরকমে জীবন চালায় এমন মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি। সঞ্চয় করা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তবু চেষ্টা করে কিছু সঞ্চয় করার। কারণ এই সঞ্চয় বিপদে কাজে লাগে। মানুষ সামান্য সঞ্চয় রাখে অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্য। জীবনের অন্তিম লগ্নে দেহের শক্তি, মনের জোর আর্থিক সঙ্গতি প্রতিযোগিতা করে নিচের দিকে নামতে থাকে। সব শক্তি হারানোর পর থাকে একমাত্র মানবসমাজের মেধাকূল ডাক্তার সাহেবই ভরসা। সাধারণ জনতার সেই ভরসার জায়গাটা সামান্য কিছু মানুষ দ্বারা ছিনতাই হচ্ছে। মেডিকেল ভর্তিতে শিক্ষার্থী নির্বাচনে রাজনৈতিক সখ্যতা, আর্থিক সামর্থ্য, অপর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক, অপ্রতুল গবেষণার, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, দালাল চক্র, ভুয়া সনদধারী ডাক্তার দুষ্টু চক্র মিলে-মিশে একাকার হয়ে মানুষকে শোষণ করছে। চাহিদা আর সরবরাহের অমিলের ফাঁক দিয়ে জালিয়াতি, ভুয়া, অনৈতিক, টাউট বাটপার গোত্র সৃষ্টি হবেই। মেডিকেল কাউন্সিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেতন নাগরিক সকলকে ফাঁকি দিয়ে কখনো আবার ম্যানেজ করে চলছে অবৈধ চিকিৎসা বাণিজ্য। পত্রিকা ও টিভি সাংবাদিক ভাইয়েরা কিছু ভুয়া ডাক্তার, ক্লিনিক, দালাল বাহিনীর লোমহর্ষক ঘটনা উদঘাটন করে আমজনতাকে জানান। তা দেখে মানুষ স্তম্ভিত হয়। ভুয়া ডাক্তার বছরের পর বছর রোগী দেখছে সবার নাকের ডগায়। খোদ রাজধানীতে ওয়ার্ডবয় চিকিৎসা দিচ্ছে, ঝাড়ুদার অপারেশন করছে! চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্বয়ং পরিচালক হাতে-নাতে স্বঘোষিত সার্জনদের ধরেছে। কোনো ডাক্তারকে ওই কর্তব্যরত ডাক্তারের গাফিলতির প্রতিবাদ করতে দেখলাম না। এমন ঘটনা যদি ঘটে সরকারি হাসপাতালে তাহলে বেসরকারি ভুঁইফোড় ক্লিনিকে কি রামরাজত্ব কায়েম হচ্ছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। হাতেগোনা কয়েকটা হাসপাতাল বাদে সবখানেই অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমাদের বহু চিকিৎসক রয়েছেন যারা সুনামের অধিকারী, মানবতাবাদী, সেবা ব্রতের প্রতীক। তাদের খ্যাতি ম্লান করছে বনিক শ্রেণির ডাক্তার ও ক্লিনিকের মালিকরা। স্বর্বসান্ত¡ রোগীর টাকা দিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে স্বাস্থ্যসেবার নামে বাণিজ্য। জীবন নিয়ে ইয়ার্কি, তামাশা আর শুধু বাণিজ্যের শিকড় উপড়ে ফেলা এখন সময়ের দাবি। সকল সরকারি হাসপাতালে শক্তিশালী দালাল ও অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট তৎপর। ডাক্তার ও কর্তাদের সঙ্গে যোগসাজসে দালালি চলে। দক্ষিণা না দিয়ে চাঁদে যাওয়া যাবে কিন্ত সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না। দক্ষিণার লুকোচুরি খেলার সাথী দালালরা রোগী ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করায়। ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার সাহেব তিন হাত লম্বা এক পরীক্ষার ফর্দ ধরিয়ে দেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্ট দিয়ে সব পরীক্ষা চলে আবার কোনোটা অনুমান নির্ভর রিপোর্ট করে রোগীর কাছ থেকে ভাগে যোগে টাকা আদায় করে। স্বাস্থ্যখাতের আর্থিক, মানসিক জুলুম সব সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। দুর্বৃত্ত চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই কর্ম বিরতি, হাতাহাতির সংস্কৃতি চলছে। বড় কোনো চিকিৎসক তার বাবার টাকায় চিকিৎসক হননি। হতাশার সঙ্গে বলতে হয় জনগণের টাকায় লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়ে সেই জনগণের সঙ্গে শঠতা, প্রবঞ্ছনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ক্লিনিকের বিল বাড়াতে মৃত রোগীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা, হাসপাতালে ডাক্তার না থাকা, বিল আদায় করতে লাশ রেখে নির্মমতা নিত্যনৈমত্তিক আচরণ ভুক্তভোগীদের গা সহ্য হয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি, ভাঙচুর, হাঙ্গামা লেগেই আছে। ভুরি ভুরি ভুয়া ডাক্তার চেম্বার খুলে বসেছে। এ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত অগনিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে সাজা দিয়েছে, তারপরও তাদের চৈতন্য ফিরছে না। জীবন নিয়ে এমন নয়-ছয় খেলায় সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে, নাকি শক্ত হাতে স্বাস্থ্যখাতের নৈরাজ্য বন্ধ করবে?
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান