লেকের সৌন্দর্য্য অবলোকন সার্বজনীন নয় কেন?
ইংরেজি লেক শব্দটির বাংলা অর্থ হ্রদ; তবে সচরাচর লেক শব্দটির বহুল ব্যবহারের কারণে বাংলা হ্রদ শব্দটির আক্ষরিক অর্থে ঠাঁই মিলেছে অভিধানে। লেক দুই ধরনের, এর একটি প্রাকৃতিক আর অপরটি কৃত্রিম। লেক বলতে চতুর্দিকে ভূমি দ্বারা আবদ্ধ পানির বড় ধরনের আধার বুঝায়। পৃথিবীর অনেক শহরেই সৌন্দর্য্য বর্ধন, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসম্মত খোলামেলা পরিবেশে হাঁটাচলা এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক রাখার জন্য কৃত্রিম লেকের সংস্থান রয়েছে। আবার এমন কিছু শহর রয়েছে যেগুলো প্রাকৃতিক লেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
ভারত বিভাজন পরবর্তী ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেলে প্রথমত ধানমন্ডি এবং অতঃপর গুলশানে দুটি অভিজাত আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করা হয়। উভয় আবাসিক এলাকার মধ্যে লেকের সংস্থান রাখা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শহরস্থ যেকোনো এলাকার লেকের সৌন্দর্য্য অবলোকনের সুযোগ শহরে বসবাসরত সকল অধিবাসীর জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু আমাদের ধানমন্ডি ও গুলশান লেক এমনভাবে করা হয়েছে যে নগরীর অধিবাসীরা চাইলেও এর চতুর্দিক দিয়ে হাঁটাচলার সুযোগ নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শহরস্থ লেকগুলোর পাড়ে মানুষের হাঁটাচলার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের বাহারী ফুলগাছের সমারোহ থাকে। এখানে যে কেউ চাইলে হাঁটাচলা পরবর্তী উপবেসনের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে বিশ্রাম নেওয়াসহ নির্মল বায়ু উপভোগ করতে পারে। ধানমন্ডি ও গুলশান লেক তৈরি পরবর্তী এগুলোর পাড় অবধি বাড়ি নির্মাণের জন্য ভূমি বরাদ্দ প্রাপ্তদের সীমানা প্রাচীর বিস্তৃত থাকার কারণে বরাদ্দকৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ব্যতীত অপর কারও লেকের পাড়ে যাওয়ার সুযোগ সীমিত ছিল। পরবর্তীতে উভয় লেকের চতুর্পাশে হাঁটাচলার পথ ও সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সুবিধাভোগীদের বাধার কারণে তা পরিকল্পনা মাফিক সফল হতে পারেনি।
সম্প্রতি ময়লা ফেলার ভাগাড় ও বস্তি হিসেবে ব্যবহৃত হাতিরঝিলকে সংস্কারের মাধ্যমে যে নান্দনিক রূপ দেওয়া হয়েছে তা অনেকটা পৃথিবীর উন্নত দেশের শহরস্থ লেকের সমরূপ। এটির সৌন্দর্য্য অবলোকনসহ এর চতুর্পাশে হাঁটাচলা ও বিনোদনের জন্য ঘোরা-ফেরা শহরের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত। হাতিরঝিল নামক লেকটির চতুর্পাশে গাড়ি চলাচলের জন্য প্রশস্ত সড়কের ব্যবস্থা থাকায় এ এলাকায় যানজট হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তাছাড়া সুপ্রশস্ত সড়ক ব্যবস্থার কারণে এটি শহরের অসহনীয় যানজট সমস্যা লাঘবে কার্যকর অবদান রাখছে।
ধানমন্ডি ও গুলশান আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠার পর প্লট বরাদ্দ সমাপ্ত হওয়ার দুই থেকে তিন যুগ পর দেখা গেছে আবাসিক এলাকা ও লেকের মূল পরিকল্পনা হতে বিচ্যুত হয়ে লেকের মধ্যে মাটি ভরাট করে সময়ের বিবেচনায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দেখা যায় লেকের পানি স্বচ্ছ ও নির্মল থাকে এবং সেখানে মাছ চাষ করে শহরবাসীর জন্য মাছের বাড়তি যোগানের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের সদ্য প্রস্তুতকৃত হাতিরঝিলসহ ধানমন্ডি ও গুলশান লেকের পানি সেভাবে স্বচ্ছ ও নির্মল নয়। লেক দুটিতে যদিও বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ করা হয় কিন্তু মাছের যোগান সম্ভাবনার তুলনায় কিঞ্চিৎ। আর হাতিরঝিলের পানি দূষণমুক্ত রাখার ব্যর্থতা না ঢাকতে পারার কারণে এটিকে এখনো মাছ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে একটি নগরের আবাসিক এলাকায় লেকের ব্যবস্থা করা হয় আমাদের ধানমন্ডি ও গুলশান লেক সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে অনেক দূরে। জনস্বার্থকে মুখ্য ভেবে সরকার চাইলে এ দুটি লেকের চতুর্পাশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ও হাতিরঝিলের ন্যায় পায়ে হাঁটার পথ ও গাড়ি চলার পথ এবং বিশ্রাম ও বিনোদনের নিমিত্ত ফুল গাছের সমারোহ ঘটিযে লেক প্রতিষ্ঠার যথার্থতাকে বাস্তব রূপ দিতে পারে। আর এটি করা হলে তা শহরটির যানজট সমস্যা উপসমে বহুলাংশে অবদান রাখবে। সরকার শত বাধা অতিক্রম করে হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন ও প্রকল্পস্থিত বিজিএমইএ ভবন অপসারণে সফলতার পথে এগিয়ে যাওয়ায় ধানমন্ডি ও গুলশান লেকের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হলে যে সফলতা পাবে তা নগরবাসী অনুধাবন করতে সক্ষম।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান