স্বাচিপ-বিএমএ দ্বন্দ্ব : লাভ হচ্ছে কার?
দিনদিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কথা বন্ধ, পারলে কেউ কারও মুখ দেখবে না, অবস্থা এমন দিকেই ধাবিত হচ্ছে। দূর থেকে সবই টের পাই, দেখি। অগ্রজ-অনুজসম চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রায় নিয়মিতই নানান অনুযোগ-অভিযোগ শুনতে পাই। শুনে কষ্ট পাই, বুকের মধ্যে ক্ষরণ হয়। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) আর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) দ্বন্দ্ব এখন চরমে, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তা প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বাচিপ-বিএমএর বর্তমান এই দ্বন্দ্ব স্বাচিপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে উৎসারিত। স্বাচিপের বিগত সম্মেলনে তা প্রকাশ্যে প্রকট আকারে চলে আসে। স্বাচিপের সভাপতি পদে কিংবদন্তি চিকিৎসক নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, না দীর্ঘদিনের মহাসচিব ইকবাল আর্সলান? কে নির্বাচিত হবেন এই নিয়ে দেশব্যাপী নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। সম্মেলনের আগে দুই প্রার্থীই এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালান। তবে শেষমেষ সম্মেলনে কোনোরকম নির্বাচন বা ঝামেলা হয়নি, বরং সাবজেক্ট কমিটির সবাই মিলে জননেত্রী শেখ হাসিনার উপরে নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। স্বাচিপের অন্যতম একজন রূপকার এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে স্বাচিপের প্রতি আমার একটা পক্ষপাত সবসময়ই কাজ করে।
বিগত সম্মেলনকে ঘিরে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে সবকিছু যেন ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয় সেজন্য প্রবাসে থেকেও আমি কিছু ভূমিকা পালন করেছিলাম। কোনো এক অদ্ভুত কারণে স্বাচিপ ও বিএমএ নেতৃবৃন্দ আজও আমার মতো এক তুচ্ছ প্রবাসী চিকিৎসকের অনুরোধ-পরামর্শকে গুরুত্ব দেন। সম্মেলনকে ঘিরে সেদিন ঢাকার নেতৃবৃন্দ আমার অনুরোধ ও পরামর্শটুকু রেখেছিলেন। ফলশ্রুতিতে অনেকটা নির্বিঘেœই সম্মেলন শেষে পরবর্তীতে জননেত্রী শেখ হাসিনা অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানকে সভাপতি ও অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজকে মহাসচিবসহ আরও কয়েকটি পদে নাম ঘোষণা করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে সভাপতি ও মহাসচিব দীর্ঘসময় নিয়ে স্বাচিপের যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন, তা ছিল ভীষণ একপেশে এবং দুর্বল। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের হিসেব মাথায় রেখে গঠিত কমিটিকে অনেকেই তাই স্বাচিপের ‘সি টিম’ বলে সম্বোধন করেন। সম্মেলনোত্তর সবাইকে নিয়ে একটি সবল কমিটি করার সুযোগ গ্রহণ না করে বরং স্বাচিপ সভাপতি নিজের অনুগত কিছু চিকিৎসককে নিয়ে কমিটি করে স্বাস্থ্য সেক্টরে তার ক্ষমতাকে একচ্ছত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তখন অন্যদের চরমভাবে কোণঠাসা করে ফেলেন। শুধু তাই নয়, স্বাচিপ ও বিএমএÑ দুই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থেকে চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থরক্ষায় ডা. ইকবাল আর্সলানের ভূমিকাও সর্বস্তরের চিকিৎসকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। বিশেষ করে দেশব্যাপী কর্মস্থলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘিœত হতে থাকলেও তা প্রতিরোধে বিএমএ-স্বাচিপ তখন তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছিল না। এমতাবস্থায় স্বাচিপ সম্মেলনের বছরখানেক পরে বিএমএ নির্বাচনেও যখন ডা. ইকবাল আর্সলানই সভাপতি পদে মনোনয়ন পাবেন বলে সবাই প্রায় নিশ্চিত, তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বিএমএর সভাপতি পদে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের নাম ঘোষণা করেন। মনোনয়ন ও সভানেত্রীর আশীর্বাদ পেয়ে ডা. জালাল চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনি মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাঠে নামলে দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের চিকিৎসকদের নজিরবিহীন সমর্থন পান। নির্বাচিত হবার পর থেকেই বিএমএ নেতৃবৃন্দ চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। চিকিৎসক স্বার্থবিরোধী কালাকানুন ‘স্বাস্থ্যসেবা আইন-২০১৬’ বাতিলসহ বগুড়া মেডিকেল কলেজ, সেন্ট্রাল হাসপাতালসহ যেখানেই চিকিৎসক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সেখানেই বিএমএর কার্যকর ভূমিকা দৃশ্যমান হয়েছে।
সারাদেশের চিকিৎসকরা, বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকরা বর্তমান বিএমএর ভূমিকায় অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করছেন। একই সময়ে এইসব ইস্যুতে স্বাচিপের সভাপতির ভূমিকায় সাধারণ চিকিৎসকরা ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় স্বাচিপ সভাপতির ভূমিকাকে অনেকেই চিকিৎসকদের সঙ্গে ‘এক ধরনের বেঈমানী’ বলে অভিহিত করছেন। জামায়াত পরিবারের সন্তান স্বাচিপ সভাপতির জামায়াত কানেকশন নিয়েও তীব্র সমালোচনা বিদ্যমান। ডা. ইকবাল আর্সলানের গ্রুপ সঙ্গত কারণেই তাই এখন কোণঠাসা। স্বাচিপের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও শুভাকাক্সিক্ষরাও স্বাচিপের বর্তমান ভূমিকায় বিরক্ত। বিএমএ- স্বাচিপের বর্তমান দ্বন্দ্বে স্বাচিপের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে আছে। অনেকেই এই দ্বন্দ্বের একটা সম্মানজনক সমাধান চাইছেন। যদিও এই দ্বন্দ্ব নিরসনে আপাতত কোনো আশার আলো চোখে পড়ছে না। স্বাস্থ্য খাতের অভিভাবক হিসেবে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী চাইলে সব পক্ষকে নিয়ে এই দ্বন্দ্বের নিরসন করতে পারেন। তবে সে রকম কোনো ভূমিকায় তাকে আমরা এখন পর্যন্ত দেখছি না। বরং স্বাচিপের প্রতি তার অন্যায্য পক্ষপাত অনেকটা দৃষ্টিকটুভাবেই প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থরক্ষায় বিএমএর প্রশংসনীয় ভূমিকা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভাল চোখে দেখছেন বলে মনে হয় না। অসমর্থিত সূত্র মতে, বিএমএ বোধ হয় তাকে বিব্রত করার জন্যই আন্দোলন করছেন বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ধারণা। আমার মনে হয়, মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি এ রকম কিছু আদৌ ভেবে থাকেন তবে তা ভিত্তিহীন। চিকিৎসকদের স্বার্থরক্ষায় বিএমএ সময়োপযোগী আন্দোলন করছে, এটি কোনো ব্যক্তি-মন্ত্রী বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। ঢাকা থেকে ফোনে, ফেসবুকে আজকাল প্রায়ই অনুজসম চিকিৎসকদের অনুরোধ পাচ্ছি। তাদের কণ্ঠ বড় অসহায় শোনাচ্ছে। তারা স্বাচিপ-বিএমএর চলমান অস্বাস্থ্যকর দ্বন্দ্বের নিরসন চাইছে। দূর থেকে অনুধাবন করতে পারছি, এবারের সমস্যাটা বেশ জটিল। স্বাচিপ-বিএমএ দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখলে ঘোলাজলে শিকার করতে কাদের সুবিধা হয়, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। তারপরও চাই, স্বাচিপ ও বিএমএর চলমান দ্বন্দ্বের একটা নিরসন হোক। দুটো সংগঠনই চিকিৎসকদের পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করুক। বর্তমান ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাচিপের সিনিয়র নেতারা বসে সমস্যা সমাধানের একটা কার্যকর পথ বের করুন। এইভাবে চললে আখেরে আমরা কেউই লাভবান হব না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ আর শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে সোনার বাংলা গড়াই যদি আমাদের সবার এক ও অভিন্ন লক্ষ্য হয়, তাহলে তো কোনো সমস্যাই সমাধানের ঊর্ধ্বে থাকার কথা নয়। স্বাচিপ ও বিএমএর জন্য শুভকামনা।
লেখক: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত/সম্পাদনা: আশিক রহমান