গণসচেতনতা : যুক্তরাজ্যের তুলনায় ঢাকা ওয়াসার পানির দাম ৯০ শতাংশ কম, তবে…
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
১৫ জুন ২০১৭ দৈনিক আমাদের অর্থনীতির প্রথম পাতায় ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, সংক্ষেপে ঢাকা ওয়াসার একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে রাজধানীবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক বলা হয়েছে যে, প্রতি ইউনিট অর্থাৎ ১০০০ লিটার পানি উৎপাদনে ঢাকা ওয়াসার খরচ হয় ১৪ থেকে ১৫ টাকা, যা দেওয়া হচ্ছে ১০ টাকায়। অর্থ দাঁড়াচ্ছে, একটি রাষ্ট্রীয় পানিশোধন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতি ইউনিটে ৪-৫ টাকা লোকসান দেয়। ফলশ্রুতিতে সৌজন্যপূর্ণ প্রশ্ন রেখে বলা হয়েছে- এই সাশ্রয়ী মূল্যের পানি আপনি অপচয় করছেন না তো? পাশাপাশি বাড়তি সৎ উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেÑ ‘একটু সচেতনতা আপনার পানি বিল যেমন কমাবে, তেমনি সেই মূল্যবান পানি অন্যের প্রয়োজনও মেটাবে’। সন্দেহ নেই তা একদম ‘গুড শেফার্ড’ বা পরোপকারী বক্তব্য, যা সচরাচর বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে থাকে অনুপস্থিত।
কারণটি হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী নদীমাতৃক দেশের রাজধানী ঢাকার আশপাশের প্রধানতম পানির উৎস বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদী কতটা অপরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ পরিপন্থী, তা সকলেই কম-বেশি জানেন। আমরা ওই নদীগুলোকে সরাসরি ও কলকারখানার বর্জ্যে চরমভাবে দূষিত, বিষাক্ত ও বিপজ্জনক করেছি। কখনো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে যথাযথভাবে সংরক্ষণে মনোনিবেশ করিনি। অথচ বংশ পরম্পরায়কে সুখী, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ করতে প্রতিটি জাতি উন্নয়নকামী হয়; যেহেতু তাতে সভ্যতার বিকাশ ও প্রগতির সোপান অন্তর্নিহিত।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের বৃহত্তর লন্ডন, থেমস ভ্যালি, সারে, গ্লোচেস্টারশায়ার, উইল্টশায়ার, কেন্ট ও অপরাপর নগরীর পানি সরবরাহে নিয়োজিত থেমস ওয়াটার ইউটিলিটিস লিমিটেড, সংক্ষেপে থেমস ওয়াটারের সরবরাহকৃত প্রতি লিটার ট্যাপ ওয়াটারের দাম ০.০৯৭ পেন্স, অর্থাৎ বাংলাদেশি ০.০৯৯৮১৩ পয়সা। এতে ১০০০ লিটার পানির দাম পড়ে ৯৯.৮১৩ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশের ওয়াসার তুলনায় থেমস ওয়াটারের দাম ৯০ শতাংশ বেশি। আবার থেমস ওয়াটারের সেই হিসাবে বোতল পানির দাম যুক্তরাজ্যে ৫০০ গুণ বেশি। পাশাপাশি জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম ‘কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’-এর সংবাদে প্রকাশ, পাঁচটি বৃহৎ লেক (হিরণ, অন্টারিও, মিশিগান, ইরি ও সুপিরিয়র, যা ইংরেজি ‘হোমস’ বলে পরিচিত) সমৃদ্ধ কানাডায় ৫০০ মিলিলিটার বা এক লিটারের অর্ধেক পানির বোতলের উৎপাদন খরচ পড়ে ০.০৮ সেন্টস, অর্থাৎ বাংলাদেশি ০.০৫২ পয়সা। সেই হিসাবে কানাডায় ট্যাপের পানির দাম ১০ শতাংশ কম; তবে তা ঢাকা ওয়াসার ১০০০ লিটার পানির দামের চেয়ে সূক্ষ্মমাত্রায় বেশি, অর্থাৎ বাংলাদেশি ১০.৪০ টাকা।
তাতে প্রশ্ন উঠে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও কানাডার ট্যাপ কিংবা বোতল পানির গুণগত মান কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত ও পানীয় হিসেবে নিরাপদ?
কানাডায় ফেডারেল আইনের বিধান মতে, দ্য কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সি পানিকে খাদ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে বোতল পানির ক্ষেত্রে তার বৈশিষ্ট্য, মান, পরিমাণ, গঠন প্রকৃতি, মানদ- ও নিরাপদ দিকটি ভোক্তার জ্ঞাতার্থে তুলে ধরার ক্ষেত্রে লেবেল, পরিশোধন, বোতলজাত, প্রক্রিয়াগত পরিশোধন, বিপণন ও প্রচারণার সবটাই আইনগতভাবে বিবেচ্য। সেই বিবেচনায় বোতল পানি দুই ক্যাটাগরিতে অর্থাৎ ‘স্প্রিং অর মিনারেল ওয়াটার’ ও ‘নন স্প্রিং অর মিনারেল ওয়াটার’ হিসেবে গণ্য। তাই বোতল পানির লেবেলে যে তথ্যাদি দেওয়া থাকে, তা ট্যাপের পানির উপযোগী বা পরিপূরক। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের থেমস ওয়াটার প্রতিদিন ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন লিটার ২৮৮টি পাম্পিং স্টেশন এবং ৩০টি অপরিশোধিত ও ২৩৫টি ভূগর্ভস্থ জলাধারের মাধ্যমে লন্ডন ও থেমস ভ্যালি এলাকার ৩১,১০০ কিলোমিটার জুড়ে ৯ মিলিয়ন বা ৯০ লাখ অধিবাসীর জন্য ট্যাপের পানি সরবরাহ করে থাকে। পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকের চাষাবাদের জন্য জৈব সার, খনিজ ফসফেট ও ১৮ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের ঢাকা ওয়াসার ওয়েবসাইটে পানি উৎপাদন ও সরবরাহ সংক্রান্ত যৎসামান্যই তথ্য রয়েছে, বাকিটা মিলেছে উইকিপিডিয়া ও অন্যত্র। এতে ১৮৭৪ সালে ঢাকার নবাব খাজা আবদুল গনির তত্ত্বাবধানে বুড়িগঙ্গার তীরে চাঁদনিঘাটে প্রতিষ্ঠা পায় প্রথম ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’, যা আজকের ঢাকা ওয়াসা হিসেবে রূপান্তরিত, সম্প্রসারিত ও পরিবর্ধিত। এখন তা ৩৬০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ১ কোটি ২০ লাখ অধিবাসীর জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থাৎ ২.২ বিলিয়নের পরিবর্তে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করে থাকে! কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ট থেকে সমগ্র ঢাকা নগরী মাত্র ২ থেকে ১৩ মিটার উচ্চতায় হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে প্রায়ই বন্যাকবলিত হয়। এতে ঢাকা ওয়াসা সেবার মানে অপ্রতুল, ভূগর্ভস্থ পানি শূন্য হওয়া, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন, দূষিত নদীর পানি, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বৃহৎ বস্তিবাসীর কারণে বিপুল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পাশাপাশি এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক জরিপে প্রকাশ, ঢাকা ওয়াসার যে ৭০ শতাংশ গ্রাহক নিয়মিত পানি পায়, তাদের ৬৩ শতাংশের মিটার রয়েছে এবং ৩ শতাংশেরই মিটার অকেজো।
তাই সূচনায় ঢাকা ওয়াসার বিজ্ঞাপন অনুসারে, ‘একটু সচেতনতা আপনার পানি বিল যেমন কমাবে, তেমনি সেই মূল্যবান পানি অন্যের প্রয়োজনও মেটাবে’, বক্তব্যটি কী সঠিক ও যথাযথ? নাকি পানির মিতব্যয়িতাপূর্ণ গণসচেনতার পাশাপাশি বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং অকেজো মিটার ও মিটারহীন পানি সরবরাহ রোধের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত অত্যাবশ্যক।
ই-মেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স