প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগের পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে ঝুলছে ২ লাখ ৬২ হাজার মামলা
এস এম নূর মোহাম্মদ : একজনের জমি অন্যজনের নামে রেকর্ড, জমির পরিমাণ ভুল, দাগ ভুল, পর্চায় আছে তো ম্যাপে নেই। ম্যাপে আছে তো পর্চায় নেই। আবার ম্যাপে থাকলেও শত বছর ধরে যে চৌহদ্দিতে মালিক সম্পত্তি ভোগদখল করে আসছেন সেভাবে নেই। ‘মাজারের’ পাশের জমি ভুলে হয়ে গেছে ‘বাজারের’ পাশে। মূলত এসব ভুলে সৃষ্টি হয়েছে নানা রকমের বিরোধ। আর অদক্ষ মাঠ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও চরম অবহেলায় ভুলে ভরা এসব ভূমি জরিপের খেসারত গুনতে হচ্ছে জমির মালিকদের।
প্রথমে ভুমি জরিপের এসব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে মামলা হতো। এরপর সরকার স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০’র ১৪৫(এ) ধারা অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর সারা দেশে ৪২টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে। বর্তমানে এ সংখ্যা ৪৩। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের ভুমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলছে ২ লাখ ৬২ হাজার ১৬৪ টি মামলা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোরগঞ্জে ৪৪ হাজার ২২২টি।
২০১২ সালে একটি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের গেজেট জারি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ট্রাইব্যুন্যালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জায়গা না পেয়ে প্রার্থীদের হাইকোর্টে রিভিশন মামলার মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে হচ্ছে। এরপর আপিল বিভাগে। আবার ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ছোটখাটো ত্রুটি সংশোধনের জন্য ভূমি প্রশাসন বোর্ড, ভূমি আপিল বোর্ড ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব দেয়া হলেও তারা সেই দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলে ভূমি জরিপসংক্রান্ত মামলার বিচার নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।
অভিযোগ রয়েছে যে, সরদার আমীনগণ এবং রেভিনিউ কর্মকর্তাগণ অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে সম্পূর্ণ মিথ্যা বর্ণনা দ্বারা রেকর্ড রাইটস্ প্রস্তুত করেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ তাদের চাহিদামতো রেকর্ড অব রাইটস্ প্রস্তুত করিয়ে নিয়ে থাকেন। এছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন বা তদন্ত ছাড়া কোনভাবেই পক্ষগণের অভিযোগের সত্য মিথ্যা নিরুপন করা সম্ভব না। কিন্তু এ আইনে জমিসংক্রান্ত তদন্ত বা পরিদর্শনের জন্য কমিশনার নিয়োগের কোন বিধান নেই। তাই দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে পরামর্শ দিয়েছেন এ সংক্রান্ত আদালতের বিচারকরা।
গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে “ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকার” শির্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিচারকরা এ পরামর্শ দেন। গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনের প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বিচারকদের মতে, ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সমূহ যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য সরকার কোন বিধিমালা তৈরি করেনি। এরফলে পর্যাপ্ত আইনের অভাবে বিপুল সংখ্যক মামলা বিচারের ক্ষেত্রে বিশেষত আরজী সংশোধন, পক্ষ স্থলাভিষিক্তকরণ বা সংযোজনের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালকে নানা প্রতিবন্ধকাতার মুখে পড়তে হচ্ছে।
বক্তারা বলেন, বিদ্যমান আইনের বিধান অনুযায়ী মামলার কোন পক্ষের মৃত্যুতে ট্রাইব্যুনাল মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারিকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে বা মৃত ব্যক্তির নাম বাদ দিতে পারেন না। ন্যায় বিচারের স্বার্থে কোন নতুন পক্ষকে যুক্ত করতেও ট্রাইব্যুনাল অপরাগ। অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে বক্তারা বলেন, আইনে বলা হয়েছে ল্যান্ডসার্ভে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধরা রায়ের তিন মাসের মধ্যে ল্যান্ডসার্ভে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। অথচ এখনো পর্যন্ত কোন অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালই তৈরি করা হয়নি। তাই দ্রুত অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার তাগিদ বিচারকদের। এছাড়া বক্তারা আরও বলেন, ল্যান্ডসার্ভে ট্রাইব্যুনাল শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে রেকর্ড অব রাইটস্ সংশোধন করার নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু নির্দেশ পালন না করলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার সুযোগ নেই। তাই আদালত অবমাননার কার্যক্রম গ্রহণ করার এবং অবমাননার দায়ে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে প্রদানের জন্য আইন সংশোধনের পরামর্শ তাদের।
আলোচনায় অংশ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো.আশফাকুল ইসলাম মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো এবং ল্যান্ডসার্ভে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরামর্শ দেন। এছাড়া জনগণের দুর্ভোগ কমাতে বিচারকদের সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি। মাগুরার ল্যান্ডসার্ভে ট্রাইব্যুনালের বিচারক শিমুল বিশ্বাস বলেন, ট্রাইব্যুনাল গুলোতে কেবল একজন করে প্রসেস সার্ভার রয়েছে। এতে তারপক্ষে বিশাল সংখ্যক মামলার প্রসেস জারি করা অসম্ভব হয়ে পরে। এছাড়া সব ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় সেরেস্তাদারের পদ সৃষ্টি করতেও পরামর্শ দেন তিনি।
লালমনিরহাটের ল্যান্ডসার্ভে ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, যথাসময়ে ভুমি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে গেজেট নোটিফিকেশনগুলো পাঠায় না। এরফলে ট্রাইব্যুনাল তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে না। এছাড়া ল্যান্ডসার্ভে ট্রাইব্যুনালের নেত্রকোনার বিচারক কামাল হোসেন ও কুড়িগ্রামের বিচারক তায়েব আলী মানচিত্র সংশোধন সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে ল্যান্ডসার্ভে ট্রাইব্যুনালের খতিয়ান সংশোধনের সঙ্গে মানচিত্র সংশোধন সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির এখতিার রয়েছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মো.জাকির হোসেন। সম্পাদনা: উম্মুল ওয়ারা সুইটি