মৃত্যুর কাছে কোনো বিভাজন নেই
মৃত্যু কোনো জাত-পাত, ভাষা-সংস্কৃতি, পাহাড়ি-বাঙাল বিভাজন মানেনি। সবাইকে সমান করে দিয়েছে। হ্যাঁ, পাহাড়ের কথা বলছি, ভূমিধসের কথা বলছি। যারা বিভাজিত করতে চান, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মৃত্যুর কাছে সবাই সমান। রাঙামাটির সুজিতা চাকমার সঙ্গে গেছেন রুমা আক্তার, অংচিং মার্মার সঙ্গে গেছেন আব্দুর রশিদ, সবাই একসঙ্গে গেছেন না ফেরার দেশে। তিন বছরের নুরী আক্তার তারই সমবয়সী বন্যা চাকমার সঙ্গে বেড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের উপরে মেঘেদের দেশে, সূতোর ওপারে। যেখানে সুবিধাবাদের সৃষ্ট পাহাড়ি-বাঙালের ভেদ নেই। যেখানে নেই পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ। মৃত্যুর বিশালতায় তাদের বিভেদ-বিভাজন সবই ক্ষুদ্র এবং তার চেয়েও ক্ষুদ্র তারা, যারা পাহাড়ি উপত্যকায় ছড়িয়েছে হিংসার বিষ। চিনিয়েছে তুমি পাহাড়ি ওরা উড়ে এসে জুড়ে বসা বাঙাল। এটা তোমার দেশ ওরা পরবাসী। বিপর্যয়ে দুজন কর্মকর্তাসহ মারা গেছেন পাঁচ সেনাসদস্য। ক্যাপ্টেন তানভীরের মৃত্যুশোক সইতে না পেরে মারা গেছেন তার দাদা। নাতিকে সমাহিত করার পরই সমাহিত করতে হয়েছে তাকে। দশমাস আগে বিয়ে করা স্ত্রী, যার মেহেদির রঙ এখনো মুছে যায়নি সে আজ নির্বাক। কাদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন তানভীর? বাঙলাভাষীদের, বাঙালদের না কী পাহাড়িদেরও? তানভীর নিজের মৃত্যুকে মাথায় করে মানুষকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন, কোনো পাহাড়ি বা বাঙালকে নয়। এই মানুষ পরিচয়টা যারা না জানে, যারা রাষ্ট্র না বুঝে, যারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব না বুঝে তারাই শুধু আলাদা আলাদাভাবে পাহাড়ি কিংবা বাঙালদের কথা বলে, বিভেদের কথা বলে, বিভাজনের দেয়াল টানার কথা বলে।
ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়েও কেউ কেউ উল্লসিত কয়েকজন সেনার মৃত্যুতে। বোধ-বিবেচনা, নীতি-নৈতিকতার এমন স্খলন দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এরা তো কালের পূরাণ কখনো পড়ে দেখেনি। এরা নানা ‘মতবাদ’ পড়েছে, শিখিয়ে দেওয়া ‘বুলি’ আউড়েছে, এরা মূলত ‘জীবন’ পড়েনি। এরা রয়েছে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে, যাকে বলা যায় ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’ বা ‘যাদু বাস্তবতা’। এদের পেছনের যারা যাদুকর তারাও রয়েছেন ঘোরের মধ্যে, নিজেদের তৈরি ‘ফ্যান্টাসি কিংডমে’। এরা একজনের মৃত্যুতে আহাজারি করে বহুর মৃত্যুতে থাকে নিশ্চুপ। হয়তো বলা হবে মৃত্যুর কারণ ও প্রেক্ষিত আলাদা। তা বুঝলাম, কিন্তু মৃত্যুর শোক তো আলাদা নয়। আয়নায় নিজ মুখ মিলিয়ে দেখুন তো, মেলে কী না। শোকের প্রকাশভেদে সেই মুখ কী দুটি হয়ে যায় না? যেদিন পাহাড় ধসে পড়ছিল, সেদিন সারারাত ছিলাম অনলাইনে। চোখ রেখেছি, ল্যাপটপে, কখনো সেলফোনের মনিটরে। সেই রাতে রাঙামাটির গণমাধ্যমকর্মী আলমগীর মানিকের যে ভয়, বেঁচে থাকার যে আকুতি, সেই একই ভয় আর আকুতি দেখেছি আরও নৃগোষ্ঠীর ভাইবোনের ভাষাতেও। ধ্বংস আর মৃত্যুর তা-ব সেদিন সবাইকে এক করে তুলেছিল। উঠে গিয়েছিল ঠগীদের সৃষ্টি করা বিভাজনের কৃত্রিম দেয়াল। সেদিন কেউ পাহাড়ি বা বাঙাল ছিল না, হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশি মানুষ। আর এটাই বাস্তবতা। যা মৃত্যু বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু সুবিধাবাদে অন্ধ ও বধির হওয়া মানুষগুলো বুঝবে কী তা? প্রশ্নটা অনেক বড়, অনেকটা পিঁপড়ের আকাশ ছোঁয়ার মতোন। আকাশ ছোঁয়ার সাধ্য সুবিধাবাদীদের আছে কী?
এই বিপর্যয়ে সরকার তো এগিয়ে আসবেই, আসবেন যারা বাংলাদেশটাকে ভালোবাসেন তারা। মৃত্যু আর ধ্বংস যেমন কোনো বিভাজন মানে না, সুতরাং বিভাজিত না হয়েই এগিয়ে আসা উচিত সবারই। বিপর্যয় সামাল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর কারণও খুঁজতে হবে। শুধু সেøাগানের মতো করে পাহাড় দখল, পাহাড় কাটা, বসতি স্থাপন এমন মাতমে না মেতে প্রকৃত কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। পাহাড় ধসের ঘটনা শুধু আমাদের দেশেই নয়, যেখানে বসতি নেই, কাটা হয় না সেখানেও ঘটে। কারও সন্দেহ থাকলে গুগল আছে ঘেটে দেখতে পারেন। পাহাড় ধসের অনেকগুলো কারণ আছে, আমাদের এখানে কোনো কারণে ঘটছে তা সঠিকভাবে নিরুপণ করা না গেলে আগামীতেও এমন বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হবে। আর একটি কথা, ঝুঁকি জেনেও যেদেশে বিল-ঝিলের উপর বস্তি গড়ে ওঠে, বিপদ জেনেও রেললাইন ঘেষে ঝুপড়ি বেড়ে ওঠে, সেদেশে পাহাড়ের নিচের বসতি বা বস্তি উঠিয়ে দেওয়া হয়তো সাময়িক সমাধান এবং তা কোনোভাবেই স্থায়ী নয়। মানুষকে বাঁচাতে স্থায়ী সমাধান খোঁজার কোনো বিকল্প নেই এবং তা শুধু পাহাড়ে নয়, সবক্ষেত্রেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান