‘উত্তরবঙ্গে মঙ্গা, ঢাকায় লাখ টাকার লেহেঙ্গা’
মঞ্জুরুল আলম পান্না
শিরোনাম দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। উত্তরবঙ্গে নিশ্চয় এখন আর কোনো মঙ্গা নেই। উপরের শিরোনামটি ২০/২২ বছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকের কোনো এক উপসম্পাদকীয়র। আমি সেটা ধার করেছি মাত্র। খুব বেশি আগের কথা নয়। আমাদের এই দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিবছর মঙ্গা হতো। মঙ্গা অর্থাৎ দুর্ভি। শুকনো মৌসুমে প্রায়ই পানির অভাবে সেচ ব্যব¯’া ভেঙে পড়ত উত্তরাঞ্চলে। সে সময় ওই অঞ্চলে বলতে গেলে কোনো ফসলই ফলত না। সিংহভাগ কৃষক পরিবার এই সময়টাতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাত। একবার সেই মঙ্গা খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করল। সামনে আবার ঈদ। এদিকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাজারগুলোতে কেনাকাটার ধুম। বাজারে নতুন আসা মেয়েদের পোশাক এক একটা ‘লেহেঙ্গা’র দাম তখন লাখ টাকার উপরে। ঢাকার শপিংমলগুলোতে সেই লেহেঙ্গা ধনীর ঘরের আলালীরা কিনছিল প্রতিযোগিতা করে। অথচ একই দেশের মাত্র সামান্য দূরত্বের মানুষেরা ছিলেন দিনের পর দিন না খেয়ে। যদিও সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ আর কিছু বেসরকারি সং¯’ার উন্নয়ন প্রকল্পে সেই মঙ্গার অভিশাপ থেকে এখন মুক্ত উত্তরবঙ্গের মানুষেরা।
এবারও ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে মানবিক বিপর্যয় ঘটল রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্যঞ্চলে। দেড় শতাধিক মানুষ পাহাড়ের ভার বইতে না পেরে ম”ত্যুকে করল আলিঙ্গন। আহত অসংখ্য। রাঙামাটির সঙ্গে চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ ব্যব¯’া একেবারে ভেঙে পড়েছে। খাদ্য সরবরাহ প্রায় থমকে দাঁড়িয়েছে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এতটাই ব্যাপক যে তার পরিমাণ গত সাতদিনেও নির্ধারণ করতে পারেনি প্রশাসন। ত্রাণ সহায়তা বলতে গেলে এখনো তেমন কোথাও পৌঁছায়নি। কেউ কেউ শুধু শুকনো খাবার খেয়ে আছে পুরো সাত দিন। শুকনো খাবার খেয়ে আর কদিন বাঁচা যায়? এরই মধ্যে পানিরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
এদিকে ঈদ উপলক্ষে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শপিংমলগুলোতে একটু স্বস্তিতে পা ফেলার মতো জায়গা নেই, বিশেষ করে ঢাকায়। শুধু মানুষ আর মানুষ। এটা ওটা, কত্তো কি কেনে! আর ওদিকে পাহাড়ের বুভুক্ষু মানুষগুলোর ছবি ছাপা হওয়া পত্রিকাগুলো পড়ে থাকে আলিশান গাড়ির ভেতর। কে বলে মানুষের পকেটে টাকা নেই? আছে, এক শ্রেণির মানুষের পকেটে দেশের আশি ভাগ মানুষের টাকা। সারা দিনরাত কেনাকাটা করেও তাদের টাকা খরচ হয় না। মধ্য আর নিম্ন আয়ের মানুষেরা যে কেনাকাটা করছেন না, তা নয়। সবাই করছেন, যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী করছেন। নতুন পোশাক না হলে যে ঈদ হবে না। অনেকে বলেন, দেশের দুর্যোগগুলো মোকাবিলার জন্য সরকার রয়েছে। আমিও একমত। কিš’ সবসময় সবকিছু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে বসে থাকার মানে হ”েছ আত্মপলায়নপরতা। সরকার কবে কী করবে, আর সে পর্যন্ত মানুষের না খেয়ে থাকার দুর্বিসহ ছবি কোনো সু¯’ মানুষ চুপচাপ দেখে যেতে পারেন না। মানুষ হিসেবে আমাদের সবারই দায়বদ্ধতা রয়েছে অন্য মানুষের প্রতি। যারা ধর্মকে খুব গুরুত্ব দেন, খুব ধর্মভীরু, তাদের প্রত্যেকের ধর্মই তো বলে ‘মনবসেবাই সবচেয়ে বড় ধর্ম’।
ঈদ মানে নাকি সবার সঙ্গে খুশি ভাগ করে নেওয়া? কই, সে কথা কজনের মনে থাকে আমাদের? একা ভালো থাকার মধ্যে আসলেই কি ভালো থাকা যায় কখনো? যারা সন্তান বা পরিবারের প্রতি সদস্যের জন্য পঞ্চাশ হাজার কিংবা লাখ টাকার কেনাকাটা করছেন, তাদের কি এই মুহূর্তে পাহাড়ের ছাদহীন, ঘরহীন, না খেয়ে থাকা বিপর্যস্ত মানুষগুলোর চেহারা একবারও মনে পড়ে না? ওদের তো ঈদ নেই, পূজা-পার্বণ নেই। এক মুঠো খাবার দরকার শুধু, একটুখানি আশ্রয় দরকার। কী হয় মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে পরম মমতায় একটুখানি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে? যারা বিদেশ যা”েছন শপিং করতে, কি হয় একবার না গেলে! এতো গেল বিত্তশালীদের কথা। একটা সময় ছিল যখন সাংস্কৃতিককর্মী, সমাজকর্মী, বিভিন্ন কাব-সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের যেকোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়াতে তারা পথে নেমে পড়তেন ত্রাণ সংগ্রহে। এখন এমনটা আর খুব বেশি দেখা যায় না। তবে এখনো সত্যিকারের কিছু মানুষ আছেন বলেই সভ্যতা এগিয়ে যায়, ধ্বংসের মধ্যেও মানুষ স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার। যারা নিশ্চয় সত্যি সত্যিই এবারও গাইবেন মানবতার জয়গান।
লেখক: কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সম্পাদনা: আশিক রহমান