লেখকের গাইড : প্রাথমিক পাঁচ ভাবনা
মাসুদ রানা
পূর্বকথন : অনেক দিন ধরে, অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেছেন লেখকদের জন্য একটি গাইড লেখার। আমার সমস্যা হচ্ছে, অনুরোধে কিছুই লিখতে পারি না, যদি না আমার ভেতর থেকে একটি তাড়না আসে। যাক, এই হাফ-টার্মের ছুটিতে একটি তাড়না অনুভব করছি বলে লিখছি। এটি একটি সিরিজ লেখা হবে। তাই, প্রথমে শুরু করছি ‘লেখকরের গাইড: প্রথমিক পাঁচ ভাবনা’ শিরোনামে।
সূচনা: আপনি যদি লিখতে চান, প্রথমেই ভাবুন এবং তারপর লিখুন। প্রশ্ন হতে পারেÑ লেখার আগে ভাবনার কী আছে? উত্তর হচ্ছেÑ আছে এবং কী আছে, তা নিয়েই ‘লেখকের গাইড’-এর ‘প্রাথমি পাঁচ ভাবনা’ উপস্থাপন করছি। আমার মতে, লেখার আগে ভাবনার আছে পাঁচটি দিক। আর সেগুলো হলো- (১) সাবজেক্ট বা বিষয়, (২) অডিয়েন্স বা পাঠক, (৩) পার্পাস বা উদ্দেশ্য, (৪) পয়েণ্ট অফ ভিউ বা দৃষ্টিকোণ, (৫) পার্সপেক্টিভ বা অবস্থান। বিষয় (ংঁনলবপঃ): লেখার বিষয় নির্ধারণ হচ্ছে যেকোনো লেখার মৌলিক ও প্রারম্ভিক উপাদান। এর জন্য প্রথমেই আপনাকে লেখার একটি শিরোনাম স্থির করতে হবে। এই শিরোনামের দিকে লক্ষ্য রেখেই আপনি আপনার লেখাটা লিখবেন। এই পর্যায়ে আপনার লেখার বিষয়ের ওপর নির্ভর করে লেখার জান্ (মবহৎব) ঠিক করে নিতে হবে। কারণ, আপনি যা লিখতে চান, তা কাহিনী আকারে লিখবেন না কবিতা আকারে লিখবেন, না সংলাপ আকারে নাটকের মতো লিখবেন, তা ঠিক করে নিতে হবে। ধরা যাক, আপনি লিখছেন একটি ভ্রমণ কাহিনী। তো, ভ্রমণটা কোন দেশে বা স্থানে হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্ট করে আপনাকে শিরোনাম লিখতে হবে। মনে করুন, আপনার ভ্রমণ কাহিনী লেখার শিরোনাম হচ্ছে ‘লন্ডনে সাতদিন’।
আপনি উপরে যে শিরোনামটি লিখলেন, সেটি অনেকটা ধ্রুবতারা হয়ে আপনার লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকবে। অর্থাৎ, আপনার লেখাটা হতে হবে লন্ডনে যাওয়া, আসা, থাকা, দেখাসহ নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে এবং তা হতে হবে পুরো সাতদিনকে ধারণ করে। পাঠক (অঁফরবহপব): লেখার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর অডিয়েন্স বা পাঠক কে বা কারা, তা নির্ধারণ করা। ‘যেমন দেবতা, তেমন পূজো’ বলে একটি কথা আছে বাংলায়। অর্থাৎ, আপনি যাকে বা যাদেরকে পাঠক ভেবে লিখবেন, আপনার লেখাটা তাদের কাছে আবেদন তৈরি করা চাই। উপরের উদাহরণ ধরেই ভাবা যায়, আপনি ‘লন্ডনে সাতদিন’ ভ্রমণ কাহিনীটি কার জন্য লিখবেন? আপনাকে ভাবতে হবে, আপনি কি লেখাটি তরুণ পাঠকদের জন্য লিখবেন, নাকি প্রবীণদের জন্য লিখবেন। তরুণদের জন্য ভ্রমণ কাহিনীতে যে অ্যাডভেঞ্চার থাকে, প্রবীণদের জন্য আর আবেদন নাও থাকতে পারে। পাঠকের বয়স ছাড়াও আপনাকে কখনো কখনো ভাবতে হবে পাঠকের সামাজিক শ্রেণি, শিক্ষা, রুচি, সংস্কৃতি নিয়ে। আর আপনার ভ্রমণ কাহিনীটিকে হতে হবে সেই সামাজিক শ্রেণি, শিক্ষা, রুচি ও সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও আবেদনময়। উদ্দেশ্য (চঁৎঢ়ড়ংব): মানুষের সকল আচরণই পার্পাসিভ বা উদ্দেশ্যমূলক। এই নিয়মের ব্যতিক্রম লেখালেখিতে নেই। তাই, শুরুতে আপনাকে ভাবতে হবে আপনি কী উদ্দেশ্য থেকে লিখছেন। আপনার পরিকল্পিত ‘ল-নে সাতদিন’ ভ্রমণ কাহিনীটির উদ্দেশ্য যদি হয় লন্ডন সম্পর্কে আপনার পাঠককে শুধুই গল্প বলে আনন্দ দেওয়া, আপনার লেখার ধরন হবে রসাত্মক বর্ণনামূলক। আর আপনার উদ্দেশ্য যদি হয় পাঠককে লন্ডন ভ্রমণে উৎসাহিত করা, আপনার লেখার ধরন হবে বর্ণনাত্মক ও তথ্যমূলক, যা পাঠকের কাছে একটি গাইড হিসেবে আবেদন তৈরি করবে। মোটকথা, আপনার লেখাকে হতে হবে আপনার ঈস্ফিত উদ্দেশ্যের পরিপূরক। আপনার লেখা যদি আপনার উদ্দেশ্যকে সমর্থন করে, সেটি হবে একটি সফল লেখা।
দৃষ্টিকোণ (চড়রহঃ ড়ভ ারব)ি: প্রতিটি লেখার একটি দৃষ্টিকোণ থাকে। আপনাকে ভেবে নিতে হবে, ব্যাকরণের কোনো পার্সন বা পুরুষ হিসেবে আপনি আপনার লেখাটি লিখবেন। আপনি লিখতে পারেন ফার্স্ট পার্সন বা উত্তম পুরুষে, কিংবা সেকেন্ড পার্সন বা মধ্যম পুরুষে, কিংবা থার্ড পার্সন বা নাম পুরুষে। ফার্স্ট পার্সনে লিখলে, আপনাকে ‘আমি’, ‘আমার’, ‘আমাকে’ শব্দ ব্যবহার করে কাহিনী লিখতে হবে। অর্থাৎ কাহিনীটি আপনি আপনার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার বিবরণ হিসেবে লিখবেন।
সেকে- পার্সনে লিখলে, আপনাকে একবচনে ‘আপনি/তুমি/তুই’, ‘আপনার/ তোমার/তোর’, ‘আপনাকে/তোমাকে/তোকে’ কিংবা বহুবচনে ‘আপনারা/তোমরা/তোরা’, ‘আপনাদের/তোমাদের/তোদের’, ‘আপনাদেরকে/তোমাদেরকে/তোদেরকে’ শব্দ ব্যবহার করে লিখতে হবে। থার্ড পার্সনে লিখলে আপনি কাহিনীর অংশ না হয়ে বরং দূরবর্তী তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কাহিনীর চরিত্রগুলোর নাম উল্লেখ করে এবং উপযুক্ত সর্বনাম ব্যবহার করে লিখবেন। থার্ড পার্সনে লেখার সুবিধা হচ্ছে এই যে, এখানে অন্তর্যামী হিসেবে কাহিনীর চরিত্রগুলোর শুধু আচরণ নয়, তার মনের ভাবনা, চিন্তা ও অনুভূতির বিবরণ দেওয়া যায়।
অবস্থান (চবৎংঢ়বপঃরাব): অনেকে লেখার পয়েন্ট অফ ভিউকে পার্সপেক্টিভের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। বাস্তবে, লেখার পার্সপেক্টিভ বা অবস্থান হচ্ছে, যে বিষয়ে লেখা হচ্ছে, সে বিষয়ে একটি অবস্থান গ্রহণ করে লেখা, যা পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত লেখা আছে, সেগুলো বিভিন্ন পয়েন্ট অফ ভিউ বা পার্সনে লেখা। আবার, প্রতিটি লেখা যে জবানীতেই লেখা হয়ে থাকুন না কেন, সেটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে, কিংবা নিরপেক্ষভাবে লিখা।
লেখার পার্সপেক্টিভের কারণে পাঠক আপনাকে বিচার করবে। সুতরাং আপনি কোন পার্সপেক্টিভে লিখবেন, তা নির্ভর করছে আপনি একটি বিষয়ে পাঠকের কাছে নিজেকে কীভাবে হাজির করতে চান তার ওপর। তবে, লেখক হিসেবে আপনি যে পার্সপেক্টিভই গ্রহণ করে থাকুন না কেন, সেখানে যথেষ্ট স্পষ্টতা না থাকলে পাঠক আপনাকে ভুল বুঝতে পারে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, নিরপক্ষে পার্সপেক্টিভের লেখকদেরকে পাঠক প্রায়শ ভুল বুঝে থাকেন।
লন্ডন, ইংল্যান্ড/ফেসবুক থেকে