যেই কপাল সেই মাথা, ফিরে ফিরে কপাল হাতা
ড. সা’দত হুসাইন
ছোট্ট শহর নোয়াখালীর সদর দফতর মাইজদী কোর্ট। গ্রাম্য প্রবাদ আর ততধিক গ্রাম্য চুটকির আখড়া। তবে এসব চুটকি এবং প্রবাদ উপভোগ্য। বার্তাবাহীও বটে। ছোট বয়সে শোনা এরূপ একটি চুটকি বা গল্পের কথা মনে পড়ছে। এটি দুই পরিবারের সু-পড়শি সম্পর্কিত চুটকি বা গল্প। ‘সুপড়শি’ সুলভ আচরণে অভ্যস্ত এক পড়শি অন্য পড়শির কোনো ভালো খবর মেনে নিতে চায় না। ভালো খবর শুনলে তীর্ষক মন্তব্য করে মজা পায়। পাড়ার এক লোক খবর দিল যে, দক্ষিণের পড়শির ছেলে এবার এম.এ পরীক্ষা দিয়েছে। শুনে উত্তরের পড়শি বলল, পরীক্ষা দিলে কি হবে, পাস করবে না। পাড়ার লোক বলল, শুনেছি পাস করেছে। উত্তরের পড়শি উত্তর দিল, পাস করলে কি হবে, চাকরি পাবে না। কয়েকদিন পর পাড়ার লোকটি এসে বলল, ছেলেটি চাকরি পেয়েছে। পড়শির সোজা উত্তর, চাকরি পেলেও বেতন পাবে না। মাস খানেক পর লোকটি আবার আসল। বলল, ছেলেটি তো বেতনও পেয়েছে। পড়শি বলল, বেতন পেলেও সে টাকায় চাল কিনতে পারবে না। লোকটি চুপ করে রইল। কদিন পর এসে মাথা চুলকিয়ে বলল, সাহেব ছেলেটি কিন্তু সত্যি চাল কিনতে পারেনি। বাজারে চালের অগ্নি-মূল্য দেখে ভয় পেয়ে ফিরে এসেছে। পড়শি গম্ভীর গলায় বলল, ‘হুম, আমি জানতাম, এমনটি ঘটবে।’
আমাদের অবস্থা হয়েছে একইরূপ। আমাদের সাফল্য গাঁথার শেষ নাই। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দুই লেনের রাস্তা চার লেন হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে, খাদ্য শস্যের উৎপাদন বাড়ছে, রেলপথ সংস্কার হচ্ছে, নতুন ক্লিনিক হচ্ছে, ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ছে। বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় ‘এ’ লেভেল পাচ্ছে; ফল প্রকাশের দিন অনেক বিদ্যালয়ে খুশির ঢেউ উঠছে। চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। এত কিছুর পরও আমরা কেমন যেন অস্বস্তিতে আছি। মনে হচ্ছে আমাদের প্রাপ্তির মধ্যে কোথাও যেন ঘাটতি রয়েছে। ছোট গল্পের সংজ্ঞার মতো নানা কিছু পেয়েও হলো না পাওয়া। সফল পরিণতি বলতে যা বোঝায় আমরা তা পেয়েছি বলে মনে হয় না। আমাদের অতৃপ্তি-অসম্পূর্ণতাগুলো নিম্নরূপ:
লম্বা লম্বা ফোর লেন মহাসড়ক হয়েছে, তবে যানজট কমেনি। মাইলের পর মাইল যানজট হচ্ছে। বলা হচ্ছে নদীর ওপর আরও সেতু লাগবে। আট লেন রাস্তায় দোকানপাট বসে যাচ্ছে, ট্রাক রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে আগে যেখানে দু-আড়াই ঘণ্টা যাতায়াত সময় ছিল, তা বেড়ে এখন চার-পাঁচ ঘণ্টা হয়ে গেছে। শহরের মধ্যেও ট্র্যাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে। তাহলে এত শত শত কোটি টাকা খরচ করে নতুন রাস্তা বানিয়ে কি লাভ হলো।
বিদ্যুতের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। ঘটা করে আকাশে রং বেরং এর লেজারের আলোক ছটা ছড়িয়ে উৎসব করা হলো। অনেক বেশি টাকা দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ কিনছি। বিল দিতে গিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তের প্রাণান্তকর অবস্থা। এখন দেখছি আবার লোডশেডিং ফিরে এসেছে। অফিসে আসার আগের মুহূর্তে বাসায় লোডশেডিং চলছিল। প্রায় প্রতিদিন আমরা লোডশেডিং খাচ্ছি। বলা হচ্ছে উৎপাদন বাড়লেও সঞ্চালন লাইনের অভাব। কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কি করার আছে?
খাদ্যশস্য উৎপাদন অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিছু চাল রপ্তানি করা হয়েছে। এখন সব ওলট-পালট খবর। চালের দর হু হু করে বাড়ছে। ক্রেতা সাধারণের মাথায় হাত। বলা হচ্ছে এটি নাকি সরবরাহ সংকট, সরকারি গুদামে চালের মজুদ প্রায় নিঃশেষ। এত খাদ্যশস্য গেল কোথায়। এসব নাকি সিন্ডিকেটের কারসাজি। সবই যেন ভেল্কিবাজি। আমাদের অবস্থাও কি এমন হবে যে, চাকরি পেলেও বেতন পাব না, বেতন পেলেও চাল কিনতে পারব না। মনে হয় আমাদের ওপর ‘কুফা’ ভর করেছে। সে কারণে আমরা দেখছি, ‘যেই কপাল সেই মাথা, ফিরে ফিরে কপাল হাতা।’
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি