‘ষড়যন্ত্র’ নয়, আগরতলা ‘সত্য’ মামলা
রাহাত মিনহাজ
আগর শব্দের অর্থ সুগন্ধি কাঠ বিশেষ। বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের সেভেন সিস্টার্সের অন্যতম ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা রাজ্যের নামকরণ করা হয়েছে এই আগর থেকেই। এক সময় পাহাড়ি এই অঞ্চলে প্রচুর আগর গাছে জন্মাতো। যা থেকেই এই এলাকার নামকরণ করা হয় আগরতলা। আগরতলা নামটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৭১ সালে ত্রিপুরা রাজ্য বিশেষ করে আগরতলা প্রচুর শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। ত্রিপুরাতে স্থাপিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পও। কিন্তু ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতেও আরেকবার আগরতলা শব্দটি বিশেষভাবে উচ্চারিত ছিল। সালটা ছিল ১৯৬৮। ওই বছরই পাকিস্তান রাষ্ট্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে দায়ের করে ‘আগরতলা মামলা’। যা পাকিস্তানি বিভিন্ন নথি, বিভিন্ন বই, পুস্তিকা আর পত্র-পত্রিকায় পরিচিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে। আলোচিত ওই মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালের এই জুন মাসে।
কিন্তু আগরতলা কি ষড়যন্ত্র মামলা? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখতেন সেই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই। তখন থেকেই তিনি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখতেন। যে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ত্রিপুরা গিয়েছিলেন। প্রত্যাশিত সহযোগিতার আশায়। যদিও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করা বা স্বাধিকার অর্জনের জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। আগরতলা মামলা নিয়ে ইতিহাস গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ উত্থান পর্ব (১৯৪৮-১৯৭০)’ বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি লিখেছেন (পৃষ্ঠা: ১১৫-১১৭) শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা যান ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে যেখানে গিয়ে তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। লেখকের ভাষায় ‘গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে তিনি আগরতলা যান। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্র শচীন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে তার কয়েক দফা বৈঠক হয়। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান।’ বঙ্গবন্ধুর এই ত্রিপুরা গমন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাসহ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন। মহিউদ্দীন আহমদের বর্ণনা অনুযায়ী আগরতলায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই দেশকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা ছিল সত্য ঘটনা। যা পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোয় ‘ষড়যন্ত্র’। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা তো গৌরব উজ্জ্বল এক অধ্যায়। যা সম্পর্কে সবার বিস্তারিত জানা খুবই জরুরি
আগরতলা মামলা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন এই মামলার অন্যতম আসামি কর্নেল (অব.) শওকত আলী। যিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ‘সত্য মামলা আগরতলা’ নামে ইতিহাসভিত্তিক সুপাঠ্য একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি বারবার এই মামলাকে ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে আখ্যায়িত করার সমালোচনা করেছেন। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যারা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম ‘ষড়যন্ত্র শব্দটি তাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম।’ কর্নেল শওকতের যন্ত্রণার কারণ বেশ যুক্তিযুক্ত। আর যাই হোক এই মামলাকে ষড়যন্ত্র মামলা বলার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান