ঈদ মোবারক
ঈদ নিয়ে লেখাও এখন সমস্যা বৈকি। বাংলা একাডেমি সম্প্রতি ঈদ বানানকে ‘ইদ’ করে দিয়েছে। এতে করে উৎসব বা আনন্দের কমতি পড়বে না জানি, তবে আমাদের মনে দাগ পড়বে বৈকি। আমি ভাষা বিজ্ঞানী নই। ভাষা বিষয়ে ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে কিছু বলাও অনুচিত। তবে বিস্ময় মানছি কি কারণে শ’ শ’ বছর ধরে আমরা ভুল বানানে ঈদ করলাম? এইসব ইদ বা ঈদের কথা বাদ দিয়ে আসুন আমরা আনন্দ অবগাহনের এই উৎসবে আমাদের অতীত ও বর্তমানকে একটু মিলিয়ে নিই।
আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি, মানুষ হবার চেষ্টা করেছি এর সবকিছুতে যারা আমার পাশে ছিল, আছে, থাকবে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। বাঙালি মুসলমান। ঈদের আগেরদিন আমাদের বাড়িঘরেও উত্তেজনার ঢেউ এসে লাগত। শুধু নামাজ পড়া আর ঈদগাহে যাওয়া ছাড়া বাকি আনন্দের কোথাও কোনো কমতি ছিল না। আমার মা বরাবরই ব্যতিক্রমী মহিলা ছিলেন। তিনি কি বুঝতেন জানি না, তবে ঈদের দিনও স্নান সেরে পোশাক পাল্টে সেমাই পায়েস রান্না করে রাখতেন আমরা খাব বলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি যেসব বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া হতো তারা কেউ ছিলেন কট্টর, কেউ পরিমিত, কেউ বা প্রচলিত আচারে অবিশ্বাসী। অথচ এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না কারও। আলাপগুলোও হতো ভিন্ন ধরনের। যেমন কে কোন লেখা পড়েছে, কাদের বাড়ির কোন পদ চমৎকার কিংবা ব্যক্তিগত বিষয়। সে আমলে কি দল ছিল না? ছিল না রাজনীতি? ছিল না আন্তর্জাতিক বা ঘরের মস্তানী? সব ছিল। কিন্তু তা নিয়ে ভেদাভেদ করার পলিটিক্স ছিল না। সময় বদলেছে। এমন একসময় এখন আমরা বলছি প্রযুক্তি ও গতি নাকি যেকোনো সময়ের চাইতে শীর্ষে আছে। তা বটে। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। মুঠোয় দুনিয়া। যার মানে ব্যপ্তি বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের মন ও চোখের সীমানা। কিন্তু এর ফলাফল কি? একদিকে অন্ধত্ব আরেকদিকে হিংসা। আজকের বাংলাদেশে এখন বেশিরভাগ মানুষই ঈদকে সম্প্রদায়গত মানুষের উৎসবের বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না। এটা তাদের দোষ নয়। সন্তর্পণে তাদের মনে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একবন্ধু দুঃখপ্রকাশ করছিলেন তার বানানো ইফতারি নিয়ে গেছিল অফিসে। সবাই মিলে খাবে বলে। সময় এলে দেখে বেশিরভাগ মানুষ উধাও। পরে সে জেনেছে তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এই ঘটনা। তার স্ত্রীর আতে বানানো ইফতার অনেকের কাছে নাজায়েজ। আবার ঈদের কদিন আগে সিডনির এক ইফতার মাহফিলে আমাকে বসতে দেওয়া হয়েছিল যিনি দোয়া পড়লেন, যিনি ইমামের কাজ করলেন তার ঠিক পাশের আসনে। এমন এক পরিবেশ আমিই যেন অন্যতম রোজাদার বা ধার্মিক। ফলে আমাদের বুঝতে হবে যে জায়গাটায় ষড়যন্ত্র বা নিজেদের সংকীর্ণ করার কাজ চলছে সেটা আসলে কাদের হাতে। ঈদের একটা বড় বিষয় সর্বজনীনতা। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানে নব্বই শতাংশ মানুষ যেহেতু মুসলমান তাদের উৎসবই হবে জাতীয় উৎসব। আর জাতীয় উৎসব মানে উৎসব যার বা যে ধর্মের হোক না কেন আনন্দ সবার। সে আনন্দে কেউ যেন বাগড়া দিতে না পারে। দুঃখের বিষয় এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারি দল এখন এতবেশি ধার্মিক সাজতে চাইছে তাদের কাছে আনন্দও যেন একতরফা। বাদবাকি রাজনীতি ধর্ম নিয়ে খেলতে খেলতে ক্লান্ত। তবে সাধারণ মানুষের এতে কিছু আটকায় না। ক্রিকেট নিয়ে এত যুদ্ধ, এত পাকপ্রীতি, এত ভারত বিরোধিতা অথচ একজন মানুষও লাহোর বা ইসলামাবাদের ঈদ শপিং করতে যায়নি। লাখের ওপর মানুষ ছুটেছে কলকাতা বা ভারতে। আমরা এমনই এক জাতি যাকে কোনো অন্ধ ফ্রেমে বাঁধা যায় না। যারা তা করে তারাই ছিটকে পড়ে।
আমার কাছে ঈদ মানে আমার বন্ধুদের পবিত্র মুখ। আমার স্বজন ও পরিচিতদের প্রার্থনা তাদের বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। সে জায়গাটা এখনো আমার কাছে ভরসার। বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে। সন্ধ্যায় তারা সবাই মিলে যখন ঈদের আয়োজনগুলো দেখতে থাকে বা ঈদ সংখ্যার লেখাগুলো পড়তে থাকে তখন কি আসলেই কেউ মনে রাখে কার কি পরিচয়? সংস্কৃতি আমাদের ধর্মীয় উৎসবেও একযোগে একসূত্রে ধারণ করে। সেই আমাদের শক্তি। শুভ হোক ঈদ উৎসব। ঈদ মোবারক।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান