বুলবুল আহমেদের কাঁধে চড়ে আমার ঈদের দিনটি কাটত
আফসান চৌধুরী
তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলন চলছি। দাবি আদায়ে উত্তাল সারাদেশ। দাবি একটাই, সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা চালু করা হোক। বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের ওই সময়টা আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার জন্ম হয়েছে ভাষা আন্দোলনের মাসেই। আর আমার শৈশব ও বেড়ে উঠা ঢাকার টিকাটুলিতে।
টিকাটুলি হলো আমাদের একটা পাড়া বা মহল্লা। টিকাটুলি এমন একটি পাড়া যেখানে বাংলাদেশের আজকের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, প্রফেশনাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাড়া ছিল। কলকাতা থেকে অনেকে এসে এখানে বসবাস করতেন। আমার যতদূর মনে পড়ে তখনকার ঈদ ছিল পাড়াভিত্তিক। পাড়ার সবাই একসঙ্গে ঈদ করতাম। একসঙ্গে ঈদ করার মজাটাই ছিল অন্যরকম আনন্দের। আমাদের এলাকায় তখন ট্রাফিক এবং ময়লা আবর্জনার স্তূপ ছিল না। তাই আমাদের পাড়া বা মহল্লাটা ছিল খুব গোছাল এবং সুশৃঙ্খল।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি, কবি সুফিয়া কামাল এবং আমরা একই পাড়ায় থাকতাম। এ ছাড়া অভিনেতা আলী যাকেরও একই পাড়ায় থাকতেন। এরকম অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব আমাদের টিকাটুলি এলাকায় বসবাস করতেন। তখন ঈদে আমরা সবাই মিলে নতুন জামা-কাপড় পড়ে মসজিদে নামাজ পড়া এবং বাসায় বাসায় গিয়ে সেমাই খাওয়া হতো।
ঈদ নিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা খুব বেশি মনে পড়ে। জীবনের প্রথম ঈদের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গিয়েছিলাম। তখন মানুষ ধর্ম চর্চা করত খুব স্বাভাবিকভাবে। কখনো কিছু প্রমাণ করার জন্য তারা ধর্ম চর্চা করত না। মসজিদের ইমাম সাহেব যখন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে কথা বলছিলেন, তখন ওই মসজিদে বসে থাকা মসুল্লিরা ইমাম সাহেবকে বলেছিলে, আপনি এসব কথা কেন বলছেন? আপনি ধর্মের কথা বলেন। এমন সংস্কৃতির মধ্যেই আমরা বড় হয়েছি। বাড়ি ফিরে ইমাম সাহেব যা বলেছিলেন তার সবকিছু মায়ের কাছে বলি। হিন্দু-মুসলমান কি তার কিছুই তো তখন আমি বুঝি না। আমার কথা শুনে মা আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। কী বলেছিলেন মা? মা বলেছিলেন, পৃথিবীতে ভালো মানুষেরাই শুধু স্বর্গে যাবে এবং সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। আর খাারপ লোকেরা যাবে নরকে এবং সে যে ধর্মেরই হোক। এটা হচ্ছে আল্লাহর কথা। আমি মনে করি, নিজেকে প্রস্তুত করার পেছনে মায়ের ওই কথাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ভালো এবং খারাপের পার্থক্যের বিষয়ে ওইদিনই আমি মায়ের কাছ থেকে দীক্ষা পাই। এটা আমার জীবনে বড় একটা শিক্ষা।
কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। ঈদে সুলতানা আপার সঙ্গে আমরা অনেকেই পাড়া ঘুরতে যেতাম। পাড়াবোধটা আমাদের মধ্যে তখন ব্যাপকভাবে কাজ করত। এখন তো আর এই পাড়াবোধটা নেই। বাংলা চলচ্চিত্রের মহান অভিনেতা বুলবুল আহমেদ, তিনিও আমাদের পাড়ার লোক ছিলেন। আমার এখনো মনে আছে, তিনি আমাকে কাঁধে করে ঘুরাতেন। বুলবুল আহমেদের কাঁধে চড়ে আমার ঈদের দিনটি কাটত বলা যেতে পারে। আসলে তখনকার ঈদের আনন্দই ছিল অন্যরকম। মানুষগুলো ছিল খুব সহজ-সরল। তখনকার খাওয়া দাওয়ায় এত চাকচিক্য ছিল না। ঈদের নতুন কাপড় বলতে, একটা পাঞ্জাবি ও পায়জামা। যেটা আমাদের মায়েরাই সেলাই করে দিতেন। খুব সাধারণভাবেই আমাদের ঈদ কেটেছে।
পরিচিতি: গবেষক ও সাংবাদিক
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি/সম্পাদনা: আশিক রহমান