দুই আনা দিয়ে কাগজের টুপি ও পটকা কিনি
নূহ-উল-আলম লেনিন
প্রত্যেক মানুষেরই শৈশব হচ্ছে আনন্দের সময়। স্বচ্ছল বা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের যে রকম শৈবব থাকে, ঠিক তেমনই দরিদ্র পরিবারের মধ্যেও শৈশবটা একটা ভিন্ন স্মৃতি হিসেবে কাটে। তখন সবার জগতটাই হচ্ছে একটা বিস্ময়ের জায়গা। যেখানে সবকিছুর মধ্যে আনন্দ খুঁজে বেড়ানো নেশা কাজ করে। আমার জন্ম একটা রাজনৈতিক পরিবারে। বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। আমরা অনেকগুলো ভাই-বোন ছিলাম। বলা যেতে পারে আমাদের কিছুটা দারিদ্র্যের মধ্যে এবং কিছুটা রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্যে কেটেছে। একদিকে বাবা জেল খাটছেন, অন্যদিকে বাড়িতে পুলিশ এসে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছে, এগুলো যেমন ছিল, আবার ঠিক তেমনই সমাজের আট দশটা ছেলের মতো শৈশবে হৈ চৈ করেই আমাদের দিনগুলো কেটেছে।
আমি শৈশবের ঈদের একটা আনন্দের কথাই বলব। যতদূর মনে পড়ে আমি তখনো প্রাইমারি স্কুলের গ-ি পার হইনি। সেই ঈদের দিনটা আমাদের জীবনের একটা অনন্য ঈদের দিন। আমাদের বাড়িতে সেদিন রান্না করার মতো কোনো খাদ্য ছিল না। আমি এবং আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই, আমাদের কোনো ঈদের বস্ত্র ছিল না। আমার বড়বোন মায়ের শাড়ি পেঁচিয়ে দু’জনকে পরিয়ে দিলেন। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকেই যেখানে বংশানুক্রমে সবাই থাকতেন, সেটাকে আমরা বলতাম পুরনো বাড়ি। বড় বোন বলল, তোরা বাজার দিয়ে পুরান বাড়ি যা।
পুরনো বাড়িতে আমাদের চাচারা সবাই থাকতেন, সেখানে অনেক খাওয়ার-দাওয়ার আয়োজন আছে। আমি সেই অর্থেই পুরনো বাড়িতে গেলাম। আমার বাবা তখন ভাষা আন্দোলনের রাজবন্দি হিসেবে কারাগারে। এসব কারণেই আমাদের পরিবারকে তখন অভাব-অনটনের মধ্যদিয়ে কাটাতে হচ্ছিল। বড় বোন পুরনো শাড়ি দিয়ে রাজার জামার মতো পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু শরীরটা খালি ছিল। গায়ে দেওয়ার মতো সে রকম কিছু ছিল না। আমরা খালি গায়েই বাজার হয়ে আমাদের পুরনো বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।
তখন প্রখ্যাত ব্রিটিশ বিরোধী ও কৃষক নেতা যীতেন ঘোষ ওই বাজারে বসা ছিলেন। যখন তিনি দেখলেন আমি আর আমার ভাই ওদিক দিয়ে যাচ্ছি ঠিক তখনই তিনি আমাদের ডাক দিলেন। উনি বুঝেছিলেন যে আমাদের ঈদের কোনো জামা-কাপড় নেই। আর তখন তিনি কাপড়ের দোকানের সামনেই বসে ছিলেন। তিনি দোকানদারকে বললেন, আপনার দোকানে কী ধরনের কাপড় আছে। তখন রেডিমেট কাপড় খুব একটা পাওয়া যেত না। কিন্তু গেঞ্জি পাওয়া যেত। তখন তিনি আমাদের দু’টো গেঞ্জি দিতে বললেন। আমরা দুই ভাই দুটো কালো গেঞ্জি পছন্দ করলাম। দু’জনকে দুটো কালো গেঞ্জি কিনে দিলেন এবং আমাদের হাতে দু’আনা করে পয়সা দিলেন। গেঞ্জি আর দু’আনা পয়সা পাওয়ায় আমরা তো ভীষণ আনন্দিত। তখন বাজারে কাগজের রঙিন টুপি পাওয়া যেত। আমরা তখন একআনা দিয়ে কাগজের দু’টো টুপি কিনি আর বাকি একআনা দিয়ে পটকা কিনে পুরনো বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
সেখানে গিয়ে সবার বাড়ি ঘুরলাম ও খাওয়া-দাওয়া করলাম। ঈদের নামাজ যেখানে পড়ানো হতো সেখানে গেলাম। আমাদের সমবয়সীদের সঙ্গে সারাদিন হৈচৈ করে কাটালাম। সন্ধ্যাবেলায় যখন ফিরলাম তখন আমরা ভরা পেটে বাড়িতে ফিরলাম। আমার শৈশবের সবচেয়ে আনন্দময় ঈদ ছিল এটা। এখন অনেক কিছু পেলেও সেই আনন্দটা আর খুঁজে পাই না।
পরিচিতি: লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি/সম্পাদনা: আশিক রহমান