গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর
যতীন সরকার
বাংলাদেশের একটা অজোপাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম। বর্তমান নেত্রকোনা জেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে আমার জন্ম হয়েছিল। সেই গ্রামে জন্মেই আমি তৎকালীন পাকিস্তানের সৃষ্টি দেখেছি এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের ধ্বংস হওয়া দেখেছি। ছেলেবেলার কথা বলতে গেলে তো অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। অনেক মধুর স্মৃতি জড়ানো সেই সময়। ছেলেবেলা থেকেই আমি ছিলাম ইচড়েপাকা। এ রকম হওয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্বটা কিন্তু আমার একার নয়, আমার অভিভাবকবৃন্দই আমাকে ইচড়েপাকা হতে সাহায্য করেছে! তারাই আমার সমবয়সীদের চেয়ে আমাকে অন্যরকম ভাবনা ভাবতে শিখিয়েছেন। আমার মুখে অনেক পাকা পাকা কথা জুড়ে দিয়েছেন। আমার সমবয়সীদের বাবা, চাচারা তাদের শালা ভাইপোদের হাতে স্কুলের পাঠ্যবই ছাড়া অন্যকোনো অপাঠ্য বই দেখলে তা শুধু কেড়েই নিতেন না, তাদের পিঠে দু-চার ঘা বসিয়েও দিতেন। অথচ আমার প্রতি আমার বাবা এবং ঠাকুরদার ব্যবহার ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলা অক্ষরগুলোর সঙ্গে পরিচয়ের পর পরই তারা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন অজস্ত্র (অপাঠ্য) পুস্তক।
গুড বয় এর সুনাম আমি একদিনের জন্যও অর্জন করতে পারিনি। নানা অপাঠ্য নিষিদ্ধ পুস্তক আমাকে এমন নেশা ধরিয়ে দেয় যে, পরবর্তীতে পাঠ্যপুস্তক দেখলেই আমার বমি আসত। বিশেষ করে গণিত বইটা ছিল আমার দুই চোখের বিষ। মেট্রিক পরীক্ষায় অংকে কিভাবে পাস নম্বর তুলেছিলাম তার রহস্য আজও আমি উদঘাটন করতে পারিনি। তখন ত্রিশ নম্বর ছিল অংকের পাস মার্ক। পাস মার্কের চেয়ে তিন নম্বর বেশি পেয়েছি এটাই ছিল আমার গর্ব। তার মানে অংক ছাড়া আর সব বিষয়ে যে আমি খুব আহামরি নম্বর পেয়েছি তাও কিন্তু নয়। ম্যালেরিয়া রোগীর কুইনেনজেলার মতো করে পরীক্ষার পড়া গলধকরণ করেছি। এভাবেই পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পরীক্ষাতেই কেবল কোনোরকম টেনেটুনে পার পেয়ে গিয়েছি মাত্র। ভাল ছাত্র হওয়ার মতো মেধা এবং প্রতিভা যেমন আমার ছিল না, তেমনি ছিল না পরিশ্রম ও সাধনা। তবুও একান্ত মেধাহীন হয়েও মুখ থেকে মায়ের দুধের গন্ধ শুকানোর আগেই, আমি চারপাশের সামাজিক, রাজনৈতিক আলোড়ন, আন্দোলন, ঘটনা ও দুর্ঘটনার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। তার মূলে ছিল আমার বাবা, ঠাকুরদার এবং পিতামহের অতি আগ্রহ। তারা যেসব আড্ডা ও বৈঠকে সমাজের রাজনীতির অনেক বড় বড় বিষয় মন্থন করতেন। সেসব স্থানে আমার যে শুধু প্রবেশাধিকার ছিল তা নয় বরং আমার অংশগ্রহণকেও তারা উৎসাহিত করতেন।
আমার ছোট মুখে বড় কথা শুনে আড্ডাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য বিরক্ত হতেন। তবে অধিকাংশ লোকেই দন্ত হতে এত শব্দ বের হতে দেখে বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে পড়তেন। তাদের চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে যেত। এর ফলে আমার বাবা ও ঠাকুরদার ছাতি যে অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠত সেটা উপস্থিত যে কেউ দেখেই বুঝতে পারতেন। সেই সঙ্গে আমাকে অতি দ্রুত ইচড়ে পাকিয়ে ফেলার ব্যবস্থাটাও এরাই করে ফেলেছিলেন। ঠাকুরদার মতো বাবাও আমার মনে অনেক ধরনের প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছেন। ছোটবেলায় যখন আমার ঘুম ভেঙে যেত তখন বিছানায় শুয়ে শুয়েই বাবা আমার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে গল্প জুড়ে দিতেন। সে সময় থেকেই আমি দেশ-বিদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বিশেষ করে তখনকার যে যুদ্ধ এসব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। তখন সাপ্তাহিক আনন্দবাজার পত্রিকা আমাদের বাজারে আসত। সেগুলো পড়ার অভ্যাসটাও তখন থেকেই গড়ে উঠে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল সেটি ছিল অত্যন্ত মধুর। আমরা গ্রামের ছেলেরা ঈদে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম ও আনন্দ করতাম। আমি যদিও কৃষক সন্তান নই কিন্তু কৃষকের সঙ্গেই ছিল আমার মধুর সম্পর্ক। কৃষকদের আমি লক্ষ্য করেছি ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে। এই কৃষকরা যে সমস্ত চিন্তা-ভাবনা করত তার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই আমার পরিচয় গাঢ় হয়ে ওঠে।
আমাদের গ্রামে কালিপূজা হতো। সেই কালিপূজায় দেখেছি মুসলমান কৃষকরাও পাঠা মানতি করত এবং সেই পাঠা কালিবাড়িতে পাঠিয়ে দিত বলি দেওয়ার জন্য। আমাদের বাড়ি থেকে চার মাইল দূরে মদনপুরে শাহ সুলতান শাহের দরগা আছে। সেই দরগায় হিন্দুরা মানতি করত। আমি যখন নেত্রকোনা যেতাম তখন আামার ঠাকুর মা আমাকে বারবার বলে দিতেন। আমি যেন এক আনার বাতাসা কিনে শাহ সুলতান এর দরগায় সিন্নি দিয়ে আসি। এছাড়া আমাদের বাড়ির পাশে দুর্গাপূজা হতো। সেই দুর্গাপূজাতে অনেক ভিড় হতো। সেই ভিড়েও আমি দেখেছি হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে যোগদান করত। শুধুমাত্র ধর্মীয় অংশটুকু বাদে সব জায়গাতে যাত্রা এবং পুতুল নাচ এসবে সবাই মিলেমিশে আনন্দ করত।
তখন আমাদের গ্রামে মুসলমানরা তাজিয়া মিছিল নিয়ে আসত মহররমের সময়। সেই তাজিয়া মিছিলটি হিন্দু-মুসলমান সব বাড়িতে যেত। এবং তাজিয়া ধারীরা এক ধরনের মর্সিয়া সঙ্গীত গেয়ে সব বাড়ি থেকে চাল, ডাল ইত্যাদি উঠাত।
ঈদের দিনে আমরা সাারাদিন বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়াতাম। দিনগুলো আজও আমার চোখে ভেসে ওঠে। আমি এভাবেই হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের বিষয়টা প্রত্যক্ষ করেছি। আমার যখন আট বছর, ১৯৪৫ সালে আমি আমার গ্রামের কাছে রামপুর প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই। ক্লাস ফোরে প্রাইমারি স্কুলে শেষ হয়। সেখান থেকে সেন্টার পরীক্ষা দিয়ে ক্লাস ফাইভে উঠি। তখন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। সকল হিন্দুদের মধ্যে দেশত্যাগের একটা ভাবনা চলে আসল। আমরাও চলে যাব এ রকম একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আমার বাবা কিছুতেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে রাজি ছিলেন না।
রামপুর স্কুলে যখন পড়তাম তখন আমাদের স্কুল থেকে আড়াই মাইল দূরে আশুজিয়া স্কুল নামে হাইস্কুলের ছাত্ররা যেত। যারা ছিল আমাদের চেয়ে বয়সে বড়। তাদেরকে দেখেই আমরা ছড়া কাটতাম। সে এক অদ্ভুত ছড়া আমাদের স্কুলের প্রশংসা আর আশুজিয়া স্কুলের বদনাম। আমরা বলতাম, রামপুর স্কুল কালো, মাস্টারগুলো ভালো এবং বেঞ্চিগুলো তিন ফুট, ছাত্রগুলো ভেরিগুড।আর আশুজিয়া স্কুলের ছাত্রদের বলতাম, আশুজিয়া স্কুল সাদা, মাস্টারগুলো গাধা এবং বেঞ্চিগুলো সরু, ছাত্রগুলো গরু। আশুজিয়া স্কুলের ছাত্ররা আমাদের তাড়া করত আর আমরা ভো দৌড় দিতাম। এভাবেই প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রজীবন আমার কেটেছে। তারপরে একসময় আমাকে আশুজিয়া স্কুলেও পড়তে হয়েছে। সেই স্কুল থেকে আমি ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাস করেছি। এভাবে নানা আনন্দ, খেলাধুলার মধ্যে আমার ছেলেবেলা কেটেছে। ছেলেবেলার কথা তো আর বলে শেষ করা যাবে না। এ রকম হাজারো স্মৃতি ঘেরা দিনগুলো আজও আমার হৃদয়ে চির সবুজ হয়ে গেঁথে আছে।
পরিচিতি: গবেষক ও শিক্ষাবিদ/মতামত গ্রহণ: সাগর গনি/সম্পাদনা: আশিক রহমান