স্বেচ্ছানির্বাসন
জুলফিয়া ইসলাম
সেই মিলিয়ে নেওয়ার সময় বুঝি এসেছে। কিছুদিন আগেও যা ছিল না। এখন সেটিই হচ্ছে। প্রচ- আনন্দের মাঝে জীবন যাপন করতেন অভিনেতা। যারা তার সঙ্গে মিশতেন তারা ভুলেই যেতেন ইনি একজন অভিনেতা। অভিনয়ের বাইরে সারাদিন সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। শরীরে কোনো রোগ ছিল না তাই মনেও আনন্দ ছিল। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা ছিল তাই সহজেই যেকোনো চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে পারতেন। দুঃখ-বিষাদ এমনভাবে অভিনয়ের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতেন দেখলে মনে হতো দুঃখের মাঝেই বুঝি তার বসবাস। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে লোকটি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এখন তার সবকিছুর উপরই মৃত্যুর ছায়া পড়েছে। কবির ঘুম থেকে উঠে দেখল জাফর বসে আছেন। বসে আছ কেন, রাতে ঘুম হয়নি?
না।
এখন কেমন আছ?
মোটেও ভালো না।
চল, তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
কবির সন্ধ্যা নাগাদ তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, রোগী কে?
অভিনেতা জবাব দিলেন, আমি।
কি হয়েছে আপনার?
কি করে বলব বলুন।
ডাক্তার হেসে বলল, বলতে না পারলে আমার কাছে কেন!
কি রোগ সেটা জানতে এসেছি।
আপনার সমস্যা কোথায় না বলতে পারলে আমি রোগ ধরব কিভাবে?
সমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারছি না।
দুঃখিত সমস্যার কথা বলতে না পারলে আমার পক্ষে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
অভিনেতা জাফর অ্যাসিস্টেন্টের কাছে ভিজিট দিয়ে বেরিয়ে এলো।
কবি রাগে গজ গজ করতে লাগল।
কি হয়েছে তোমার তা ডাক্তারকে বলবে না কেন?
আমার কিছু বলার ছিল না কবির।
তাহলে এখন কি করতে চাও?
কিছুই করতে চাই না। অথচ মনে মনে বলল, তোমরা কেউ বুঝতে পারছ না আমি কি ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মধ্যে আছি। ডাক্তার কেন পৃথিবীর তাবৎ মানুষ চেষ্টা করলেও আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে পারবে না। তিনি বাসায় ফিরে গেলেন। পূর্ব জীবনের সমস্ত তার কাছে অর্থহীন। সমস্ত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজন, হাসি ঠাট্টা সবই অর্থহীন মনে হয়। পুরো জীবনটাই ধূসর মরুভূমি। পুরনো জীবনের সবকিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে ফেললেন। কিন্তু কেন? সবকিছু যেন তার কাছে অর্থহীন হয়ে গেল? এ কী মৃত্যু দৃশ্যে অভিনয়েরই কারণ? কিন্তু মৃত্যু সম্বন্ধে তো তিনি সচেতন নন। আর সচেতন হবেনই বা কি করে? মৃত্যু সম্পর্কে তো তার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যু কল্পনা জীবনকে অসাড় করে তুলেছে। কিছুতেই মুক্তি মেলে না। জীবনকে মনে হয় ছলনাময়ী। কিন্তু সত্যিকারের মৃত্যু মানুষকে ভীত করে না। মানুষ যা কিছু চরম মূল্যে নির্ধারণ করে রাখে সে সমস্তকে অর্থহীন করে দেয়। জীবনে সমস্ত কৃতিত্ব ও অস্তিত্ব অসাড় হয়ে যায়। জীবনটা শুধুমাত্র রঙিন ফানুস। চুপসানো বেলুনের মতোই। মৃত্যুর অভিজ্ঞতা যে অর্জন করেনি মৃত্যু সম্বন্ধে তার উক্তিগুলো মনগড়া বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অসুস্থতাই অভিনেতার কাছে এ চিহ্নটুকু রেখে গেছে। কিন্তু সে অসুস্থতা কি, তার লক্ষণ কি অভিনেতা বুঝতে পারেন না। কখনো শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বন্ধ হয়ে আসা এবং হৃদপি-ের অহেতুক লাফালাফি টের পান। অহেতুক অস্থিরতা। কোথায় কি যেন প্রাপ্তির আশা অথচ কিছুই না, তাকে শক্তিহীন করে তোলে। এমনি বিরাট পৃথিবীতে একাকী জীবন যুদ্ধে তিনি ক্লান্ত।
এই রকম অসুস্থতা তিনি জাগ্রত এবং নিদ্রিত অবস্থাতেও অনুভব করেন। দুটো একটি কারণ যদি তিনি বুঝতেই চান তবে দেখতে হবে এই ভাদ্রের গরমে রেল লাইনের পাশের বস্তির একটি ছেলে রেল গাড়ির নিচে কাটা পড়ল। অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যু চোখে দেখেও সেই পরিবারটির যন্ত্রণায় অংশগ্রহণ করা গেল না। রাস্তার চেনা ভিক্ষুকটি পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে তবু কিছুতেই মরবে না। চেনা জানা মানুষগুলোর কষ্ট তার অন্তরে অসহ্য ব্যথার সৃষ্টি করে। এসবই হলো অভিনেতার অসুস্থতা। তিনি যে বাড়িটিতে থাকেন তার সামনেই খেজুর গাছ। বাতাসে গাছের পাতা ঝিরঝির করে কাঁপে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা নীল রঙের আকাশ দেখা যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে স্বচ্ছ নীল আকাশে উঁকি দিয়ে দেখা অভিনেতার অভ্যাস। তার বাড়ির চারিদিকে জঙ্গলে ঢাকা। মাঝে মাঝে কুকুর বিড়ালের আনাগোনা। ভাদ্রের কড়া রোদেও গাছপালা পাখি দেখতে তার ভালো লাগে। বর্ষার মেঘ মল্লার, ¯িœগ্ধ জগৎ তার মাঝে আবেগের সৃষ্টি করে। শীতের পূবালী বাতাস শিশির সিক্ত ভেজা মাঠের উপর হাঁটতে তার ভালো লাগত। কখনো বা ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে ¯িœগ্ধ শান্ত হাওয়া তার মনে দোলা দিত। জীবন ছিল তার নিকট অতৃপ্ত বাসনা। মৃত্যুকে তিনি ভয় পেতেন না। জীবনের শেষে মৃত্যুর জন্য তৈরি হতে তিনি প্রস্তুত।
কিন্তু আজ, আজ কেন সব বদলে গেল? জীবন কী তবে নেশা? যার আবেদন ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। অর্থ, সম্মান, বিত্ত, নারী কোনোকিছুই পরিপূর্ণতা দিতে পারে না? আরও সম্মান আরও অর্থের জন্য মরিয়া হয়ে পড়া। কিন্তু এ তো শুধুই অতৃপ্তি বাড়ায়। চেতনার তীব্রতা মনে হতাশার সৃষ্টি করে। সবকিছু মনে হয় অর্থহীন। মৃত্যু তাকে তিলে তিলে গ্রাস করেছে। যদিও মরবার মতো অবস্থা তার নয়। এখন তার জীবন্মৃত অবস্থা। এ যে কি কষ্টদায়ক! তবুও কি বেঁচে থাকার জন্য একবার শেষ চেষ্টা করা উচিত নয়?
মিলির কথা মনে পড়ল। হ্যাঁ, মিলিকে এখন তার প্রয়োজন। একবার ওর কাছে গিয়ে কী দেখবে? অনেকদিন পর মিলির সঙ্গে দেখা হলো। উভয়ে কুশল বিনিময় করল। অভিনেতা প্রসঙ্গ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই ওদের কথাবার্তা বেশি দূর গড়ায় না। অভিনেতা জাফর মনে মনে হতাশ হলেন। মিলিকেও স্বাভাবিক মনে হলো না। অভিনেতা কথা বাড়াতে চাইলেন না। তবুও নিরুপায় হয়ে বললেন, মিলি আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না যার ওপর নির্ভর করা যায়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, দর্শন-ধর্ম সবকিছু থেকে আমি দূরে সরে গেছি। সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। কিছুই নেই আমার। সবকিছুই আমার কাছে মৃত। জীবনের কোনো অর্থ নেই। তোমার ওপর কি নির্ভর করা যায় না? আমার ওপর কীভাবে নির্ভর করবে? আমি এখন অন্যের স্ত্রী। আমাদের আগের সম্পর্কে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ও আচ্ছা তাই তো? এটুকু তো ভেবে দেখিনি? তুমি আমাকে কী দিতে পারো। দেবার মতো তোমার কিই বা আছে? আমরা সবাই দেউলে। সবাই একা। মিলি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। অভিনেতা রাস্তায় নেমে হাঁটা শুরু করলেন। যেদিকেই নির্ভর করতে চান সবই কেমন শূন্য, ফাঁকা। জীবনটাই এখন তাসের ঘর। সে ঘরে স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন তিনি। (শেষ)
লেখক: কথাসাহিত্যিক
সম্পাদনা: আশিক রহমান