জাস্ট মৌমিতা
যায়নুদ্দীন সানী
আর হ্যাঁ। নম্বরটার আগে একটা ম্যাসেজও ছিল, আজকেই যোগাযোগ করুন। দেরি হয়ে গেল না তো?
Ñ দেখি ফোন করে।
Ñ আর শোন, কোনো কম্পেনসেশন যদি চায়, তাহলে সবকিছুর রিটেন ডকুমেন্ট রাখবে কিন্তু।
Ñ তা তো অবশ্যই। এখন রাখছি, দেখি দেরি করে ফেললাম কি না।
‘করুন?’ আপনি করে কেন? সীমার মুখে আপনি ডাক? সামথিং রং। কিছু একটা ঘাপলা আছে। ওদিকে রুমা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মোবাইল নম্বরটা বলছে। আমি লিখছি আর ভাবছি, ‘করুন’ কেন?
চার. এখানে একটা সিগনেচার করুন। ভদ্রমহিলা আরও কিছু জায়গা দেখিয়ে দিলেন। সব জায়গায় একে একে সই করলাম।
Ñ উই আর ডান। এখন আপনি চাইলে নিয়ে যেতে পারেন।
আমি এখানে এসে পৌঁছেছি বেশ কিছুক্ষণ আগে। ভদ্রমহিলার নাম শান্তা। একটা এনজিও চালান। নো পাত্তা অফ সীমা। তবে আমার জন্য একরাশ সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে ছিল। একটা একটা করে শুনছি, আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠা-া একটা অনুভূতি নেমে যাচ্ছে। মাথা এখনো ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। সকালে ফোন নম্বরটা পাওয়ার পরে যে পুলক বোধ করছিলাম, সারা শরীরে টিপিক্যাল প্রেম প্রেম রোমাঞ্চের শিহরণ ছড়াচ্ছিল, তা উড়ে গেছে।
সীমার কথা এতদিন মনে পড়েনি বলব না, তবে মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ অপরাধ বোধ ঘিরে ধরত। তাই প্রাণপণে চেষ্টা করতাম সব কিছু ভুলে থাকতে। প্রথম প্রথম সমস্যা হলেও, পরে আর বিশেষ অসিবুধে হয়নি। আর খোঁজ খবর নেওয়ার সুযোগও ছিল না। কোথায় গেছে, কেউই জানি না। প্রথমটায় ওর বাবা মার কাছে উঠেছিল, পরে সেখান থেকেও একদিন চলে যায়। কোনো এক গ্রামে, একটা এনজিওতে নাকি চাকরি পেয়েছে। এই বলে বেরিয়ে যায়। সেটাও আমি জানতে পারতাম না, আমার প্রাক্তন শাশুড়িই একদিন ফোন করে জানান। উনার উদ্দেশ্য, আমি আর নতুন কিছু জানি কি না, তা জানতে চাওয়া।
Ñ কে হয় আপনার?
সম্বিত ফিরে পেলাম। ভদ্রমহিলা আমাকেই বলছেন।
Ñ আমার প্রাক্তন স্ত্রী
Ñডিভোর্স?
Ñ জ্বি।
Ñ আপনি জানতেন না?
Ñ কি জানতাম না?
Ñ এই যে, উনি কি করতেন?
Ñ না। আই মিন, আমরা জানতাম ও একটা এনজিও তে চাকরি করে। মানে ওর মা আমাদেরকে, মানে আমাকে তেমনটাই বলেছিলেন।
Ñ আই সি। এখানে অনেকেই তাই করে। প্রফেশানটা তো আর বলার মতো কিছু না। ইউ নো…
সবকিছু এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। কেমন চাবি দেওয়া পুতুলের মতো একটার পর একটা কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। ভদ্রমহিলা একজন আয়া টাইপ কাউকে ডাকলেন। বললেন, নিয়ে আসতে। আমি তখনো বুঝে উঠতে পারছি না আমার কি করা উচিত। কিংবা আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কি? ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম
Ñ আরেকটা কথা জানতে পারি?
আমার সঙ্গে অফিসিয়াল কাজ শেষ। সম্ভবত ভেবে নিয়েছিলেন আমার প্রশ্নও শেষ। তাই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমার প্রশ্নে ধীরে ধীরে চোখ তুললেন
Ñ বলুন।
Ñ আমার নামটা কি ও…, মানে… সীমাই কি আপনাকে জানিয়েছে?
মহিলা এবার একটা স্মিত হাসি দিলেন। সম্ভবত আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা… উনি কোনো ভুল করছেন না। ব্যাপারটা তো ভুল হওয়ার ব্যাপার না, ব্যাপার হচ্ছে, সীমা সত্যি কি চাইছিল?
Ñ হ্যাঁ।
কেমন যেন মিলছে না। আমাদের ছাড়াছাড়ির সময় কি ও প্রেগন্যান্ট ছিল? তাহলে বলল না কেন? অ্যাটলিস্ট জানাতে তো পারত। নাকি পরে ঘটেছে ব্যাপারটা। বাচ্চাটার ডেট অফ বার্থ জানতে পারলে কাজে দিত। কিন্তু তেমন কিছু না হলে, শুধু শুধু সাহায্য নেওয়ার মেয়ে সীমা না। আর ওর বাবা মা বেঁচে থাকতে, তাদের কাছে সাহায্য না চেয়ে আমার কাছে চাওয়া, কি প্রুভ করে? অনলি ইফ… বাট তেমন কিছু হলে আমাকে আগে কেন বলল না? কিছু মিলছে না। ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম
Ñ আর কি বলেছে?
Ñ আর কি মানে?
Ñ আর কিছু মানে…আমার নাম আপনারা জানলেন কিভাবে?
Ñ একটা নার্সিং হোমের সঙ্গে আমাদের কন্ট্রাক্ট আছে। সেখানেই বাচ্চাটা হয়। তো, বাচ্চাটা হওয়ার সময় ওর খুব ব্লিডিং হয়। ওকে জানানো হলো ব্লিডিং থামানো যাচ্ছে না এবং হয়তো ওকে বাঁচানো যাবে না, বাচ্চার ব্যাপারে কিছু বলার আছে কি না।
Ñ তখন আমার নাম বলল?
Ñ হ্যাঁ।
Ñ বাট কেন? আমি আসলে যেটা জানতে চাইছি… আমি মিন, বাচ্চার বাবা হিসেবে কি আমার নাম বলেছিল?
Ñ সেটা তো আমরা জানতে চাইনি। তবে সীমা বলত ‘ও কেবল আমার’।
দিস ইজ টিপিক্যাল সীমা। ভদ্রমহিলাকে প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
Ñ তাহলে… আই মিন… আমাকে ডাকলেন কেন?
Ñ আসলে আমাদের এই এনজিওটা বেশ কিছু ব্রোথেল নিয়ে কাজ করে। স্পেশালি এখানে জন্ম নেওয়া চাইল্ডরা যেন আবার এই পেশায় না আসে, সেটাই থাকে আমাদের চেষ্টা। আমরা ইউজুয়ালি আমাদের হোম নিয়ে যাই। ছোট্ট হোম, বুঝতেই পারছেন, বেশি বাচ্চা অ্যাকোমোডেট করতে পারি না। তাই চেষ্টা থাকে, কেউ যদি অ্যাডপ্ট করে। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোনো নির্দিষ্ট কারও কাছে বাচ্চাটাকে দিতে চায় কি না?
Ñ আই সি। বাট… স্টিল, হোয়াট ডিড শি সেড? আমি আসলে জানতে চাই, আমার ব্যাপারে ও কি বলেছে?
Ñ ইজ দ্যাট ইম্পরট্যান্ট?
আমি বোধহয় বেশি এক্সাইটেড হয়ে যাচ্ছি। তাই তো, এটা কি সত্যিই এত জরুরি? সীমা একটা শেষ অনুরোধ করেছে। আই সুড অনার দ্যাট। তারপরও মনে একটা খচখচ থেকেই যাচ্ছে। আমার মনের অবস্থা বোধহয় উনি বুঝতে পারলেন। Ñ বাচ্চার বাবা কে, তা কি খুব জরুরি?
Ñ অ্যাটলিস্ট ডেট অফ বার্থটা?
Ñ একই তো কথা। এনিওয়ে, ডেট অফ বার্থটা বলব না। এটা উনার শর্ত। তবে আপনার ইচ্ছামতো একটা ডেট অফ বার্থ দিয়ে বার্থ সার্টিফিকেট করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। ইফ ইউ উইশ। বাই দ্য ওয়ে, বাবার পরিচয় নিয়ে আপনি এত উতলা হচ্ছেন কেন? আপনার সন্তান হলে অ্যাডপ্ট করবেন, আর না হলে করবেন না?
Ñ ঠিক তা না। বাট… জাস্ট কিউরিওসিটি… ও আসলে কি বলেছে? মানে…
Ñ এ নিয়ে আমি আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিব না। আপনি ঠিক করুন, আপনি বাচ্চাটাকে অ্যাডপ্ট করতে চান কি না। চাইলে, দুটো ব্যাপার মেনে নিতে হবে। এক, ওর আসল ডেট অফ বার্থ জানতে পারবেন না আর দ্বিতীয় ওর বাবার নাম, সেটা অবশ্য আমরা জানিও না। আমাদের এখানে ফর্মে বাবার নামের অপশন রাখিনি। ডেট অফ বার্থ বলতে পারব না কারণ এটা উনার লাস্ট রিকোয়েস্ট টু মি। অ্যাম আই ক্লিয়ার? ইউ ক্যান গেস এনিথিং। আর একটা কথা, আমরা সব ওখানকার সব প্রেগন্যান্ট মহিলাদেরকেই ফলোআপ করতাম। আর তাই সীমাকে বেশ খানিকটা চেনার সুযোগ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সীমা আলাদা ধাঁচের মেয়ে। ব্লিডিং যখন চলছিল, তখন কিছু টাকা হলেই আমরা বড় কোনো হাসপাতালে যেতে পারতাম। বাট, নিজের জন্য সাহায্য চাইতে আপনার নাম সীমা উচ্চারণ করেনি। অ্যান্ড আই থিংক কোনোদিনই বলতও না। শেষ মুহূর্তে যে বলেছে, তা ও বলেছে ওই বাচ্চাটার জন্য। যখন ওকে বললাম, এমন কেউ কি আছে, যাকে অনুরোধ করলে এই মেয়েকে অ্যাডপ্ট করে এখান থেকে উদ্ধার করবে, তখন একবার শুধু আপনার নামটা শুধু বলল। তারপরেই আবার বারণ করল। সম্ভবত ভেবেছিল, আপনি ভাববেন… মানে এই মুহূর্তে যেটা ভাবছেন, আরেকজনের পাপ আপনার ঘাড়ে চাপাচ্ছে কি না।
আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ কথাগুলো শুনতে লাগলাম।
Ñ এদিকে আপনার ফোন নম্বর, অ্যাড্রেস কিছুই আমাদের কাছে ছিল না। জানতাম শুধু নাম। তাই উনার নাম আর ছবি দিয়ে একটা ফেসবুক আকাউন্ট খুললাম। আর আপনার নামে যত ফেসবুক আকাউন্ট আছে, স্পেশালি ঢাকা যাদের অ্যাড্রেস, তাদের সবার কাছেই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম। জাস্ট লাক ট্রাই করা। বেশ অনেকদিন থেকেই ট্রাই করছি। আর দু-একদিনের মধ্যে আপনাকে না পেলে হয়তো… যেমন ফুটফুটে সুন্দর হয়েছে মেয়েটা, অনেকেই অ্যাডপ্ট করতে চায়। আমরা কি করব ভাবছিলাম, আর সেই মুহূর্তেই, ইউ রেস্পন্ডেড।
কথাগুলো কিছু কানে ঢুকছে, কিছু ঢুকছে না। নিজের প্রতি ঘৃণা তৈরি হচ্ছে? প্রায়শ্চিত্ত করবার কোনো সুযোগ কি পাব? জানি না। তবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, সীমার শেষ অনুরোধ আমি রাখব। রুমা ব্যাপারটায় আপত্তি জানাক আর না জানাক, এই অনুরোধ অবশ্যই আমি রাখব। Ñ আর হ্যাঁ, আরেকটা শর্ত আছে। ওর নাম চেঞ্জ করবেন না। ওর নাম হবে মৌমিতা। জাস্ট মৌমিতা। আপনার নামের কোনো অংশ যোগ করবেন না। প্লিজ। এটা উনার লাস্ট রিকোয়েস্ট অ্যান্ড শর্ত। সো, প্লিজ, জাস্ট মৌমিতা। (শেষ)
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান